টাকা ফেরত এসেছে বটে। তবে তদন্তকারীদের হাতে। প্রতারণার জাল বিছিয়ে আদতে যাঁদের পকেট থেকে টাকা বার করে নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের কাছে কি ফিরবে?
সারদা গোষ্ঠীর থেকে পাওয়া প্রায় ১ কোটি ১৯ লক্ষ টাকা সম্প্রতি তদন্তকারী এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-কে ফেরত দিয়েছেন মিঠুন চক্রবর্তী। অভিনেতা তথা তৃণমূল সাংসদ মিঠুনের বক্তব্য, গরিবের থেকে আত্মসাৎ করা টাকা তিনি নিজের বা পরিবারের জন্য খরচ করতে পারবেন না। সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন-সহ বিভিন্ন অভিযুক্তের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করেও ইডি কিছু টাকা আটক করেছে। সারদার বিপুল সম্পত্তিও এখন তদন্তকারীদের হাতে আটক, যার বাজারদর ১৪শো কোটি টাকা!
কিন্তু যে গরিব আমজনতাকে ঠকিয়ে সারদা এত বিত্তের অধিকারী হয়েছিল, তাঁরা কিছু ফেরত পাবেন কিনা, সে নিশ্চয়তা নেই। বরং সারদা-তদন্তে যুক্ত ইডি-কর্তারা জানাচ্ছেন, ব্যাপারটা বিশ বাঁও জলে। কেন?
ইডি-র ব্যাখ্যা: যে আইনকে সামনে রেখে তারা সারদা-তদন্ত করছে, সেই প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট’ (পিএমএলএ)-এর কোথাও এমন সংস্থান নেই। বলা নেই যে, ইডি আটক সম্পত্তি বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরাতে পারবে। আটক সম্পত্তি নিলামের অধিকারও ইডি-কে দেওয়া হয়নি। একই ভাবে মিঠুন চক্রবর্তীর থেকে পাওয়া টাকা বা অভিযুক্তদের অ্যাকাউন্টের বাজেয়াপ্ত অর্থও ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে ফেরানোর কোনও আইনি সুযোগ নেই।
তা হলে উপায়? ইডি’র কৌঁসুলি সোমনাথ বসু বলেন, ‘পিএমএলএ-তে অপরাধ প্রতিরোধের (প্রিভেনশন) কথা বলা হয়েছে। অপরাধ ঘটে যাওয়ার পরে আমানতকারীদের সম্পত্তি ফেরানোর বিষয়ে কিছু বলা নেই। তাই বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি নিলাম করতে হলে সংসদে বিল এনে আইনটাই বদলে ফেলতে হবে।’’ উদ্ধার নগদ টাকা ফেরাতে হলেও এ ছাড়া রাস্তা নেই বলে ওঁদের অভিমত।
তবে সে পথে এগোতে হলে সময় লাগবে বিস্তর। বিলম্ব এড়াতে বিকল্প একটি পথের সন্ধান বাতলাচ্ছেন আইনজীবীদের একাংশ। যাঁদের বক্তব্য: মামলার ফয়সালা ও সাজা ঘোষণা হয়ে গেলে এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারে। শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিলে ‘জনস্বার্থে’ আমানতকারীদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে পারে ইডি।
ঘটনা হল, নিম্ন ও উচ্চ আদালত মিলিয়ে সারদা-মামলার নিষ্পত্তিও যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। এমন দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। যেমন ইডি-সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েকটি ব্যাঙ্কের অভিযোগের ভিত্তিতে কলকাতায় এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছিল ২০০৭-এ। পিএমএলএ-তে তাঁর সম্পত্তি আটক করা হয়। ‘‘সে মামলা এখনও চলছে। সম্পত্তিও আটক হয়ে পড়ে রয়েছে।’’- বলেন এক ইডি-অফিসার।
তদন্তকারীদের তথ্য মোতাবেক, সারদা বাজার থেকে তুলেছিল প্রায় ২৫শো কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ইডি-র হাতে আটক সারদা-সম্পত্তির বাজারদর হবে প্রায় ১৪শো কোটি। অসম, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ— চার রাজ্যের মধ্যে শুধু পশ্চিমবঙ্গে আটক হয়েছে হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি। এক লপ্তে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি রয়েছে সারদা গার্ডেনসে— প্রায় পাঁচশো কোটি টাকার। যদিও তা এখনও আইন অনুযায়ী বাজেয়াপ্ত করতে পারেননি তদন্তকারীরা। ইডি-সূত্রের খবর: আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা র পরে তা বাজেয়াপ্ত করার আবেদন জানাবে ইডি। আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের কথায়, ‘‘যতক্ষণ না অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। আটক করেই রাখতে হবে। আর বাজেয়াপ্ত না-হলে বিক্রিও করা যাবে না।’’
ধরা যাক, অভিযোগ প্রমাণিত হল। সম্পত্তি বাজেয়াপ্তও করা গেল। তার পরেও কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে— ওই সম্পত্তি কিনবে কে? বস্তুত ব্যবসায়ী ও আইনজীবী মহলের অনেকেরই ধারণা, বিতর্কের দাগ লাগা এমন সম্পত্তি কিনতে খুব একটা আগ্রহ দেখা যাবে না। ‘‘বিকোলেও আশানুরূপ দাম মিলবে কিনা সন্দেহ।’’— মন্তব্য এক জনের।
সারদায় ক্ষতিগ্রস্তদের একাংশ পশ্চিমবঙ্গ সরকার গঠিত শ্যামল সেন কমিশন মারফত ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, সরকারি হিসেবে যার পরিমাণ ১৪৮ কোটি টাকা। এটা কী ভাবে সম্ভব হল?
আইনজীবীরা জানান, রাজ্য টাকা দিয়েছিল নিজের তহবিল থেকে। রাজ্য এ ভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে পারলেও ইডি-পারে না। কারণ, আইন তাদের সে অধিকার দেয়নি। কাজেই মিঠুন চাইলেও তাঁর ফেরানো টাকা প্রতারিত মানুষের হাতে পৌঁছচ্ছে না।
অন্তত এখনই নয়।