বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।
ইউনেস্কোর দেওয়া ‘বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র’ স্বীকৃতির সেই বিতর্কিত ফলক বসানোর সময় কোনও অনুমতি নেননি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। যে সব জায়গায় ফলক বসানো হয়েছে, তা তাদের মালিকানাধীন হওয়া সত্ত্বেও কেন অনুমতি নেওয়া হল না, এই প্রশ্ন তুলে উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে পুলিশের দ্বারস্থ হল শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট। এ ব্যাপারে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার অনলাইন। কিন্তু তাঁরা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
শান্তিনিকেতনকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করার পর থেকেই অভিযোগ উঠছে, এই কাজের জন্য উপাচার্য নিজে কৃতিত্ব নিতে চান তো বটেই, আচার্য হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাও তিনি তুলে ধরতে চান। এই আবহে সম্প্রতি বিশ্বভারতীর পক্ষে উপাসনা গৃহ, ছাতিমতলা এবং রবীন্দ্রভবনের উত্তরায়ণের সামনে শ্বেতপাথরের ফলক বসানো হয়েছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’। তার ঠিক নীচে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিদ্যুতের নাম রয়েছে। তাতে কবিগুরুর উল্লেখ নেই। তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
ফলক-বিতর্কে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ছবি বুকে নিয়ে ধর্না কর্মসূচি শুরু করেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। শনিবার সেই কর্মসূচি ন’দিনে পড়েছে। রাজ্যপাল তথা বিশ্বভারতীর রেক্টর সিভি আনন্দ বোসও এ বিষয়ে জবাব তলব করেছেন। পাশাপাশি তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি মুছে দেওয়ার চেষ্টা হলে কোনও ভাবেই তা বরদাস্ত করা হবে না। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তথা রাজ্য বিজেপির অনেক নেতাকেই এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মেলাতে দেখা গিয়েছে। যার জেরে স্বাভাবিক ভাবেই চাপ বেড়েছে বিদ্যুতের উপর। এ বার তাঁর বিরুদ্ধে শান্তিনিকেতন থানায় অভিযোগও দায়ের করল ট্রাস্ট।
ট্রাস্টের বক্তব্য, শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহ, ছাতিমতলা, শান্তিনিকেতন গৃহ-সহ মূল আশ্রম এলাকা তাদের সম্পত্তি। অথচ তাদের অনুমতি ছাড়া এ ভাবে ফলক বসানোয় শান্তিনিকেতনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বিঘ্নিত হয়েছে উপাসনাগৃহের শান্তিও। ট্রাস্টের সম্পাদক অনিল কুমার বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে কোনও পরামর্শ এবং কোনও অনুমতি না নিয়েই শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের জায়গায় ফলক বসিয়েছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। যা অতীতে কখনও ঘটেনি। এ ছাড়াও শান্তিনিকেতনে নাম ফলক দেওয়ার রীতিও নেই। আর আমাদের সম্পত্তির উপরে এ ধরনের ফলক বসানোর কোনও ক্ষমতাই নেই কর্তৃপক্ষের। তাঁরা আইনবিরোধী কাজ করেছেন। এই মর্মেই আমরা শান্তিনিকেতন থানায় উপাচার্যের বিরুদ্ধেই অভিযোগ জানিয়েছি।’’
এই মুহূর্তে শান্তিনিকেতনে নেই বিদ্যুৎ। বিশ্বভারতী শুক্রবার প্রেস বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, অফিস সংক্রান্ত কাজের জন্য বাইরে গিয়েছেন উপাচার্য। তাঁর অনুপস্থিতিতে উপাচার্যের দায়িত্ব সামলাবেন সঞ্জয়কুমার মল্লিক। বিশ্বভারতীর একাংশের বক্তব্য, চলতি মাসের ৮ তারিখ উপাচার্য হিসাবে বিদ্যুতের পাঁচ বছরের কার্যকালের স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হচ্ছে। মেয়াদ বৃদ্ধির চেষ্টা করতেই দিল্লি গিয়েছেন উপাচার্য। এর মধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হওয়া নিয়ে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ মুখ খুলতে চাননি। তবে কর্তৃপক্ষের একটি সূত্রের বক্তব্য, যে সব এলাকায় ফলক বসানো হয়েছে, তা খাতায়কলমে ট্রাস্টের সম্পত্তি হলেও, দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে বিশ্বভারতী। আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)। কর্তৃপক্ষ দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন মানে ফলক তাঁরা বসাতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে ট্রাস্টের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। শুধুমাত্র উপাচার্যকে চাপে ফেলার জন্যই পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছে ট্রাস্ট।
ফলক-বিতর্কে ইতিমধ্যেই রাজনীতির রং লেগে গিয়েছে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কড়া সমালোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বিতর্কিত ফলক সরিয়ে দেওয়ার জন্য ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন কেন্দ্রকেও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা এক্স (সাবেক টুইটারে) হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে যে বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র বিশ্বভারতীকে তৈরি করেছিলেন, বর্তমানে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। কিন্তু বর্তমান কর্তৃপক্ষ সেই স্থানের স্মারক হিসাবে যে ফলকটি বসিয়েছেন, তাতে উপাচার্যেরও নাম রয়েছে, বাদ কেবল গুরুদেবের নাম!’’ মমতার বার্তা, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ, এই অহংকারী, আত্মপ্রদর্শনবাদের নমুনাটিকে সরিয়ে দেওয়া হোক এবং গুরুদেবকে যাতে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেশ জানাতে পারে, তার ব্যবস্থা হোক।’’ পরে মুখ্যমন্ত্রীকেও পাল্টা চিঠি দিয়েছেন বিদ্যুৎ। চিঠিতে মমতাকে নিশানা করে লিখেছেন, ‘‘স্তাবকেরা আপনাকে যা বলেন, আপনি তা-ই বিশ্বাস করেন। আপনি আসলে এখনও কান দিয়ে দেখেন।’’ ফলক সরানো নিয়েও উপাচার্য চিঠিতে জানিয়েছেন, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)-এর নির্দেশ মতো ফলক তৈরি হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যেই তা সকলে দেখতে পাবেন।
এ ব্যাপারে মমতার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন রাজ্যপাল বোস। রাজভবন সূত্রে খবর, রাজ্যপালও বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। বোস সংবাদমাধ্যমের সামনেও বলেছেন, “গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ আমাদের আবেগ এবং অনুভূতি। তিনি গোটা ভারতের সংস্কৃতির প্রতিনিধি। তাঁকে উপেক্ষা করা কখনওই উচিত নয়।” একই কথা বলেছেন বিরোধী দলনেতা। তিনি বলেন, ‘‘এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়। কতগুলি বিষয়ে বাংলা ও বাঙালির ইমোশান আছে, রেসপেক্ট আছে। তা হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁদের সম্মান দেওয়ার বিষয়ে কোনও রকম জেদাজেদি থাকতে পারে না।’’ বিদ্যুৎকেও নিশানা করেছেন শুভেন্দু। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এটা নিয়ে উপাচার্যের এত ইগোর কী আছে? এটা তৃণমূল বলেছে বলে আমি বলব না, তা তো হতে পারে না। এই ফলক নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। ভিসি (উপাচার্য বিদ্যুৎ) যদি এই ফলকটি করে থাকেন, তা হলে সংশোধন করুন।’’
বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের নাম বাদ যাওয়ায় ক্ষুব্ধ আশ্রমিক থেকে শুরু করে প্রাক্তনী ও বিশ্বভারতীর শিক্ষকদের একাংশ। এমন ঘটনা অতীতে কোনও দিন ঘটেনি বলেও বিশ্বভারতীর অনেকের দাবি। বিশ্বভারতীর প্রথা অনুযায়ী কোনও উদ্বোধনী ফলক বা স্বীকৃতি ফলকে সাধারণত কারও নাম উল্লেখ করা হয় না। ঠাকুর পরিবারের সদস্য তথা প্রবীণ আশ্রমিক সুপ্রিয় ঠাকুর আক্ষেপ করে আগেই বলেছেন, “বর্তমান উপাচার্য বিশ্বভারতীর হর্তা-কর্তা-বিধাতা হয়ে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলে কেউ ছিলেন, আজ বোধহয় তাঁরা ভুলে গিয়েছেন। এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি এখানে।’’ আর এক আশ্রমিক তথা প্রাক্তনী অনিল কোনারেরও মন্তব্য, “৭০ বছরে আমি কোনও উপাচার্যের নামের কোনও ফলক এখানে দেখিনি। এই রীতি এখানে চলে না। উনি নিজের মতো করে একের পর এক ঐতিহ্য ভেঙে চলেছেন।’’
বিশ্বভারতীর শিক্ষক সংগঠন ভিবিইউএফএ-র সভাপতি সুদীপ্ত ভট্টাচার্যও আগে দাবি করেছেন, যেখানে যেখানে ফলক লাগানো হয়েছে, তার মালিকানা হয় শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের, নয়তো পূর্ত দফতরের। তাই ফলক বসানোর কোনও আইনি অধিকার উপাচার্যের নেই। তিনি বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথকে মুছে দিয়ে নিজের নামে এই প্রচার করার ব্যাপারটি নিয়ে আইনি পরামর্শ করছি। যে ভাবে আচার্যের নাম ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে তাঁর সম্মতি নেওয়া হয়েছে কি না, তা-ও আমরা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জানতে চাইব।’’