আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
মাঝে এক দিনই শুধু তিনি যাননি। সে দিন সিবিআই হাজির হয়েছিল তাঁর বাড়িতে। ওই এক দিন বাদে ১৬ অগস্ট থেকে প্রতি দিনই সিজিও কমপ্লেক্সের সিবিআই দফতরে যেতে দেখা গিয়েছে সন্দীপ ঘোষকে। সকালে ঢুকতেন সিবিআই দফতরে। বার হতেন রাতে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ডাকে সাড়া দিয়ে গোয়েন্দাদের মুখোমুখি হওয়ার পর কখনও ১০ ঘণ্টা, কখনও ১১ ঘণ্টা, কখনও আবার ১২ ঘণ্টা পরেও সেখান থেকে বার হতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু শনিবার ধারাবাহিক সেই হাজিরায় ‘যতি’ পড়ল। সিবিআই দফতরে আসতে দেখা গেল না আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপকে। শনিবার সন্দীপ হাজিরা এড়িয়েছেন না কি তাঁকে তলব করা হয়নি সে বিষয়টি যদিও এখনও স্পষ্ট নয়।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার তদন্তভার হাতে পাওয়ার পর থেকেই সিবিআইয়ের আতশকাচের নীচে ছিলেন সন্দীপ। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে গত ১৪ অগস্ট আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব হাতে নেয় সিবিআই। তার পরেই সন্দীপকে সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরার নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা। রক্ষাকবচ পেতে হাই কোর্টের দ্বারস্থও হয়েছিলেন সন্দীপ। তবে আদালত তাঁকে সিবিআইয়ের কাছে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ১৬ অগস্ট দুপুরে সিবিআইয়ের গাড়িতে চেপে তাঁকে সিজিও কমপ্লেক্সে প্রথম যেতে দেখা যায়। তার পর থেকে প্রতি দিনই সিবিআই দফতরে হাজিরা দিতে গিয়েছেন আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ। তবে এখনও পর্যন্ত মাত্র এক বারই সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলেছিলেন তিনি। ১৭ অগস্ট সিবিআই দফতরে প্রবেশ করার মুখে তিনি জানান, তদন্তে সব রকম সাহায্য করবেন। তার পর থেকে প্রতি দিনই তাঁকে সাংবাদিকেরা বহু প্রশ্ন করেছেন। সব প্রশ্নের প্রেক্ষিতে সন্দীপ ছিলেন নীরব!
নবান্ন সেই আবহেই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের নির্দেশ দেয়। এর পর সেই তদন্তভার কলকাতা হাই কোর্ট সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়। আরজি করের জোড়া তদন্ত শুরু করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। দ্বিতীয় মামলাতেও সন্দীপের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দু’টি মামলাতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপকে। প্রথম মামলাটিতে প্রশাসক হিসাবে ঘটনার দায় বর্তেছে তাঁর উপর। দ্বিতীয় মামলায় সরাসরি অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সন্দীপের প্রাক্তন সহকর্মী তথা আরজি করের প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি আদালতে জানিয়েছিলেন, সন্দীপের বিরুদ্ধে চিকিৎসার জৈব বর্জ্য দুর্নীতি, সরকারি টাকা নয়ছয়, ভেন্ডার নির্বাচনে স্বজনপোষণ, নির্মাণকার্যে আইন ভেঙে ঠিকাদার নিয়োগ ছাড়াও বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কথা। সেই সূত্রেই তাঁকে জেরা করতে গত ২৫ অগস্ট নিজ়াম প্যালেস থেকে সিবিআইয়ের একটি দল সন্দীপের বাড়ি পৌঁছয়। রাত পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে তল্লাশি অভিযানও চালান তদন্তকারীরা। তবে পরের দিন অর্থাৎ ২৬ অগস্ট আবারও সিজিও কমপ্লেক্সে হজিরা দেন সন্দীপ।
এর মধ্যেই চিকিৎসক খুনের ঘটনায় সন্দীপের পলিগ্রাফ পরীক্ষার জন্য অনুমতি চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় সিবিআই। শিয়ালদহ কোর্ট অনুমতি দেয়। ২৬ তারিখই সন্দীপের পলিগ্রাফ টেস্ট করানো হয়। তার পরেও সিবিআই দফতরে পর পর চার দিন হাজিরা দিয়েছেন আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ। তবে শনিবার সিজিও কমপ্লেক্সে দেখা গেল না তাঁকে।
অন্য দিকে, চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার ১৮ দিন পার হয়েছে শনিবার। গত ৯ অগস্ট চিকিৎসক খুনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। ঘটনার তদন্ত প্রথমে শুরু করে কলকাতা পুলিশ। এই ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করে তারা। এর পর গত ১৩ অগস্ট ওই মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের ডিভিশন বেঞ্চ। ১৪ অগস্ট মামলার তদন্ত শুরু করে সিবিআই। দিল্লি থেকে বিশেষ দল কলকাতায় এসে তদন্ত শুরু করে। ১৮ দিন কেটে গেলেও এখনও পর্যন্ত সিবিআইয়ের তরফে প্রকাশ্যে মামলার তদন্ত সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি। মামলার সঙ্গে যুক্ত বেশ অনেক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু সিবিআই এই ১৮ দিনে নতুন করে কাউকে গ্রেফতার করেনি। ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করেছে। বর্তমানে তিনি আদালতের নির্দেশে প্রেসিডেন্সি সশোধনাগারে জেল হেফাজতে রয়েছেন। সেখানে তাঁর পলিগ্রাফ পরীক্ষাও হয়। মোট সাত জনের এই পরীক্ষা করেছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু পলিগ্রাফ পরীক্ষা থেকে কী জানতে পেরেছেন, তা-ও জানাননি তাঁরা। এর মধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এই মামলার শুনানি করে। সিবিআইয়ের থেকে মামলার তদন্তের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ‘স্টেটাস রিপোর্ট’ চায়। মুখবন্ধ খামে সেই রিপোর্ট জমাও দিয়েছে সিবিআই। কিন্তু তাতে কী আছে, তা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।