মেয়র-পদে ইস্তফা দেওয়ার পরে সব্যসাচী দত্ত। বৃহস্পতিবার বিধাননগর পুরভবনে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।
তাঁর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা-নোটিস চ্যালেঞ্জ করে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই বিধাননগরের মেয়র পদে ইস্তফা দিলেন সব্যসাচী দত্ত।
তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার জন্য বিধাননগর পুরসভার কমিশনার যে নোটিস দিয়েছিলেন, তা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন সব্যসাচী। বুধবার সেই নোটিস ত্রুটিপূর্ণ বলে হাইকোর্ট খারিজ করে দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বৃহস্পতিবার মেয়র পদে ইস্তফা দিয়ে সব্যসাচী দাবি করলেন, ‘‘মামলায় আমার নৈতিক জয় হয়েছে। ওই নোটিস যে ত্রুটিপূর্ণ ছিল, আদালত তা মেনে নিয়েছে। এর পর আমার আর কিছু বলার নেই।’’
দু’দিনের মধ্যে নতুন করে সব্যসাচীর বিরুদ্ধে অনাস্থা নোটিস দেওয়ার জন্য পুর-চেয়ারপার্সনকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেই নোটিস আসার আগেই পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তীর কাছে তাঁর ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে সব্যসাচী বলেন, ‘‘আমি মেয়র না থাকলে আর অনাস্থার প্রয়োজন হবে না। জনগণের ভোটে জেতার পরে মেয়র হয়েছিলাম। আজ যিনি মুখ্যমন্ত্রী, তিনি বারবার শিখিয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষের পাশে থাকতে। কিন্তু তাঁদের কথা বলতে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তাতে বুঝেছি এই পদে থেকে আন্দোলন করা সম্ভব নয়। সে কারণেই ইস্তফা দিলাম।’’ চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা পরে বলেন, ‘‘ইস্তফাপত্র পেয়েছি। আইন মোতাবেক পরবর্তী পদক্ষেপ হবে।’’ তৃণমূলের মহাসচিব ও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘পরাজয় অনিবার্য বুঝেই সব্যসাচী পদত্যাগ করেছেন।’’
রাজ্যের বিদ্যুৎ কর্মীদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিধায়ক ও মেয়র সব্যসাচী বিক্ষোভ দেখানোর পরেই তাঁর বিরুদ্ধে সপ্তাহ দুয়েক আগে অনাস্থা আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম সব্যসাচীকে মেয়র পদে ইস্তফা দিতে ফোনে অনুরোধ করেছিলেন। তখন ইস্তফা না দিয়ে অনাস্থা-নোটিসের ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’ নিয়ে মামলা করেন সব্যসাচী। সরকারি গাড়িতে চেপেই এ দিন বিকেলে পুরভবনে এসেছিলেন সব্যসাচী। নিজেই আনুষ্ঠানিক ভাবে ইস্তফা দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে পুরভবন থেকে বেরিয়ে তিনি যান বিধাননগরে শিক্ষকদের অবস্থানমঞ্চে। সেখানেও শিক্ষাদফতর ও মন্ত্রীর ভূমিকার সমালোচনা করেন সদ্যপ্রাক্তন মেয়র। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘পদত্যাগের পরেও সব্যসাচী যা করছেন, তাতে দলের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হচ্ছে।’’
তিনি মেয়র থাকাকালীন রাজারহাট-গোপালপুরের জলা বোজানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের দ্বারস্থ হয়েও সুরাহা পাননি বলে অভিযোগ করেন সব্যসাচী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পুলিশ, বিভিন্ন সরকারি দফতরের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত রাজ্য সরকারের তরফে কোনও সদিচ্ছা দেখতে পাইনি।’’ যার প্রেক্ষিতে পার্থবাবুর কটাক্ষ, ‘‘মেয়র হিসাবে তাঁর তো পূর্ণ ক্ষমতা ছিল। কেন তা প্রয়োগ করে তখন উনি সে সব ঠেকাননি?’’
বিজেপিতে যাবেন কি না, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে সব্যসাচী বলেন, ‘‘আমি এখনও তৃণমূলেরই কাউন্সিলর ও বিধায়ক। অন্য কোনও দলে যাওয়ার ব্যাপারে এখনই কোনও কথা হয়নি। আর রাজনীতিতেই থাকবেন কি না, তা নিয়েও স্পষ্ট জবাব না দিয়ে সব্যসাচী বলেন, ‘‘রাজনীতি করতেই হবে, এমন কোনও ব্যাপার নেই। তবে অসৎ জিনিসের সঙ্গে আপস করতে কখনও পারিনি, যতদিন বাঁচব পারবও না।’’ দু’দিন বাদে ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে যাওয়ার বিষয়ে সব্যসাচীর বক্তব্য, ‘‘বিধায়কদের জন্য বিশেষ পাস থাকে। সেটা এখনও পাইনি। কী করব, তা ওই দিন সকালে ভাবব।’’ পার্থবাবুর পাল্টা যুক্তি, ‘‘শহিদের প্রতি সম্মান থাকলে যাবেন। দলের কারও এই কর্মসূচিতে আমন্ত্রণের প্রয়োজন হয় না।’’
এ দিকে বিধাননগরের পরবর্তী মেয়র নির্বাচনে সতর্ক পদক্ষেপ করতে চাইছে তৃণমূল। সব্যসাচী দত্তের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আসার পর থেকেই এ নিয়ে দলের অন্দরে আলোচনা শুরু হয়। তিনি পদত্যাগ করায় নতুন মেয়র বাছাই অনির্বার্য হয়ে পড়লেও এ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে চাইছেন না দলীয় নেতৃত্ব। দলের এক শীর্ষনেতা বলেন, ‘‘এখন দলের সামনে একুশে জুলাইয়ের কর্মসূচি সব থেকে জরুরি। তাছাড়া নতুন মেয়র বাছাইয়ের জন্য একমাস সময় পাওয়া যায়। ততদিন ডেপুটি মেয়র দায়িত্ব এবং মেয়র পারিষদেরা কাজ সামলাবেন। তাড়াহুড়োর করে কিছু করা হবে না। যা হবে তা সকলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে।’’
সব্যসাচীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা পড়ার সময় থেকেই পরবর্তী মেয়র হিসেবে ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে ২০১১ সালের পরে তৃণমূলে যোগ দেওয়া রাজারহাটের এই প্রাক্তন সিপিএম নেতাকে নিয়ে দলের অন্দরে একাংশের আপত্তি রয়েছে। এই গুঞ্জনের শুরুতেই তা প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছিলেন বিধাননগর পুরসভার মেয়র পারিষদ দেবাশিস জানা। মেয়র পদে সম্ভাব্য প্রত্যাশীর তালিকায় তখনই ঢুকে পড়ে তাঁর নাম। ‘দল চাইলে মেয়র হতে চান’— সংবাদমধ্যমে এ কথা বলে একইভাবে এই পদের অন্যতম দাবিদার হিসেবে সামনে এসেছিলেন পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তীও। কৃষ্ণার পরিচিতি তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ। আবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে দলীয় পতাকা নিয়ে তৃণমূলে এসেছিলেন তাপস। বিধাননগরের রাজনীতির এই চেনা বিন্যাসের বাইরেও আলোচনা চলছে তৃণমূলে। স্থানীয় বিধায়ক সুজিত বসুকে মেয়র করা যায় কি না, দলের একাংশ তা নিয়েও আলোচনা করছেন। সেক্ষেত্রে বিধাননগর পুর এলাকার ভোটার না হওয়ার যে বাধা রয়েছে, তা কীভাবে দূর করা যায়, তা নিয়েও দলে কথা শুরু হয়েছে। সুজিত নিজে অবশ্য এ সব নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বিধায়ক সুজিত মেয়র হলে বিধাননগরের কাজ করতে সুবিধা হবে, দলের এই অংশের যুক্তিও এইরকমও। আবার ওয়ার্ড বিন্যাসের নিরিখে রাজারহাট থেকে কাউকে মেয়র করা হোক এমন দাবিও জল্পনায় এসেছে। বিভিন্ন নাম নিয়ে জল্পনা চললেও মেয়র বাছাইয়ের ব্যাপারে দলের কাউন্সিলরেরাই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন বলে তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।