গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
এক ‘অদ্ভুত’ প্রবণতা সংগঠনে। জমানা বদল হলেই বদলে যায় সব মুখ। সর্বভারতীয় স্তর থেকে বুথ— সর্বত্র দায়িত্ব সরে যায় এক হাত থেকে অন্য হাতে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রাক্তনদের আর কখনও দায়িত্বে ফিরতে দেখা যায় না। কারণ, পরেও এক নতুন জমানা আসে। আর এক দফা নতুন মুখ দায়িত্ব পায়। পুরনো দিন কিছুতেই ফেরে না। তাই ‘পুরনো’দের অনেকেই আর সক্রিয়তায় ফিরতে চাইছেন না। সমস্যা সমাধানে মাঠে নামতে হচ্ছে আরএসএসকে।
গোটা দেশেই বিজেপিতে এই ‘সমস্যা’ রয়েছে। দলের প্রবীণেরা সে কথা মানেন। কেন্দ্রীয় স্তরে বদল এলেই রাজ্যে রাজ্যে বদলে যায় সাংগঠনিক দায়িত্বের মুখ। সেই লাইনেই বদলায় জেলা, মণ্ডল এবং বুথ। লালকৃষ্ণ আডবাণী বা মুরলী মনোহর যোশী বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। নব্বইয়ের দশকে আডবাণীর ‘রামরথ যাত্রা’ বা যোশীর নেতৃত্বে শ্রীনগরের লালচকে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন বিজেপির ইতিহাসে ‘মাইলফলক’। দু’জনেই এখন নবতিপর। সংগঠনে সক্রিয় থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই জমানার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুখ কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও এখন তেমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নেই। প্রথম নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে তাঁদের অনেককে দলীয় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সরকারে আনা হয়েছিল। ধীরে ধীরে সরকারি দায়দায়িত্ব থেকেও তাঁরা নানা ভাবে অবসৃত। অথবা প্রায় গুরুত্বহীন। বসুন্ধরা রাজে, উমা ভারতী, বিএস ইয়েদুরাপ্পা, বিনয় কাটিয়ার, সুমিত্রা মহাজন, বেঙ্কাইয়া নায়ডু, রবিশঙ্কর প্রসাদ, শাহনওয়াজ হুসেন, রাজীবপ্রতাপ রুডি— উদাহরণ অনেক।
একই ছবি রাজ্যে রাজ্যেও। কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার চলাকালীন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি ছিলেন অসীম ঘোষ। এখন দলের নীচের স্তরের তরুণ কর্মীদের অনেকে তাঁর নামও জানেন না।
উঁচু স্তরে অবজ্ঞা সয়েও অনেকে দল ছাড়েন না। যশবন্ত সিন্হা, শত্রুঘ্ন সিন্হা, কীর্তি আজাদের মতো কয়েকটি নাম ছাড়া দলত্যাগের দৃষ্টান্ত কম। কিন্তু জেলা বা তার নীচের স্তরে অনেকেই দল বদলে নেন। অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় না থাকায় সেই প্রবণতা আরও বেশি। ২০২১ সালের ভোটের আগে আলিপুরদুয়ারে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছিলেন গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা। তাঁর দলবদল রাজ্য দফতরে ঝড় তুলেছিল। কারণ, জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ারে গঙ্গাপ্রসাদ বিজেপির ‘স্তম্ভ’ ছিলেন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মুখে প্রাক্তন জেলা নেতা জীবন চক্রবর্তী ‘বিদ্রোহী’ হন বাঁকুড়ায়। বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকারের বিরুদ্ধে নির্দল হয়ে নেমে পড়েন। বেশি ভোট পাননি। কিন্তু সুভাষ হেরে গিয়েছেন। যে দৃষ্টান্ত দেখে এবং দেখিয়ে অনেকের আশঙ্কা, সংগঠনে কোণঠাসা পুরনো নেতারা দলকে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারেন।
গত বেশ কিছু বছরে বীরভূমে দুধকুমার মণ্ডল, কালোসোনা মণ্ডলরা বিস্মৃতিতে। দলের কোনও দায়দায়িত্বে তাঁরা নেই। নানা মহলে তাঁদের কথাবার্তাতেও সংগঠনের প্রতি মোহভঙ্গেরই ইঙ্গিত। রাজ্য বিজেপির এক প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদকের কথায়, ‘‘এঁরা ভোটের সময়ে সামনে দাঁড়িয়ে লড়লেন। কেউ মার খেলেন, কেউ রক্তাক্ত হলেন, কারও বাড়ি আক্রান্ত হল, কারও ব্যবসা নষ্ট হল, কেউ মিথ্যা মামলায় ফাঁসলেন। তার পরে দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন এল। তাঁদেরও সব দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হল।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘আমি এঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলছেন, আর মাঠে নামবেন না।’’
বীরভূম জেলার একমাত্র বিজেপি বিধায়ক অনুপ সাহা অবশ্য এই অভিযোগ মানছেন না। তিনি বলছেন, ‘‘সকলেই মাঠে নামবেন। দুধকুমারদা, কালোসোনাদা সকলকে ভোটের সময়ে সক্রিয়ই দেখা যাবে।’’ দুবরাজপুরের বিধায়কের দাবি, ‘‘ওঁরা দু’জনই আমাদের জেলায় দলের প্রবীণ নেতা। সাংগঠনিক রাজনীতি এবং ভোটযুদ্ধে এক সময়ে তাঁদের সামনে রেখেই দল লড়েছে। পরে নতুন প্রজন্মও উঠে এসেছে। তারা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, প্রবীণ নেতারা দূরে থাকবেন।’’
রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সহ-সভাপতি তথা রাজ্য কার্যকারিণীর বর্তমান সদস্য রাজকমল পাঠক অবশ্য সংগঠনের এই সমস্যার কথা মানছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজনীতিতে যিনি যত বেশি দিন থাকেন, তিনি তত পরিপক্ব হন। সংগঠনের উচিত সেটা কাজে লাগানো। তাতে দলের যেমন উপকার হয়, তেমনই দলের প্রতি সাধারণ মানুষের ভরসাও বাড়ে।’’ রাজকমলের আক্ষেপ, ‘‘এটা নিয়ে অনেক বার বলার চেষ্টা করেছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি।’’
সূত্রের খবর, এ বার সেই ‘কাজের কাজ’ করার চেষ্টা করছে আরএসএস। সংগঠনের নানা স্তরে ক্ষোভের কথা সঙ্ঘ জানে। আদি-নব্য দ্বন্দ্বের কথাও তাদের অজানা নয়। তাই এখন থেকেই সমন্বয়ের কাজ শুরু করছে সঙ্ঘ। সব অংশকে এক সুতোয় গাঁথতে ব্লক স্তর (সঙ্ঘের পরিভাষায় ‘খণ্ড স্তর’) থেকে সমন্বয় বৈঠক শুরু করা হচ্ছে। সব পক্ষের সঙ্গে কথাও বলা হচ্ছে। সকলকে কোনও না কোনও কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। বঙ্গ বিজেপির ভরসা আপাতত সেটুকুই।