গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
একটানা ১১ দিনের সফরে পশ্চিমবঙ্গে আসছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর প্রধান মোহন ভাগবত। আরএসএসের ইতিহাসে সরসঙ্ঘচালকের এত দীর্ঘ বঙ্গবাস এই প্রথম। কলকাতা এবং বর্ধমানে একগুচ্ছ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার কথা সরসঙ্ঘচালক ভাগবতের। তার মাঝেই দু’দিন ফাঁকা রাখা হয়েছে সঙ্ঘের সর্বোচ্চ কমিটি (অখিল ভারতীয় টোলি)-র বৈঠকের জন্যও। যা এ বছর কলকাতাতেই বসছে। ঘটনাচক্রে এমন একটা সময়ে ভাগবতের এই বেনজির দীর্ঘ পশ্চিমবঙ্গ সফর হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ টানা ছ’মাস ধরে উত্তপ্ত। ও পার বাংলায় সংখ্যালঘুর উপরে অত্যাচারের অভিযোগ এ পারে সঙ্ঘের পালে হাওয়া জুগিয়েছে বলে আরএসএসের একাংশের ধারণা। তাই ভাগবতের এই বেনজির দীর্ঘ বঙ্গবাসকে বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গেও জুড়ে দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
বুধবার দক্ষিণবঙ্গ আরএসএসের সদর দফতর ‘কেশব ভবন’-এ সাংবাদিক সম্মেলন করেন আরএসএসের পূর্ব ক্ষেত্রীয় (পূর্ব ভারত) প্রচার বিভাগের সহ-প্রমুখ জিষ্ণু বসু এবং দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত প্রচার প্রমুখ বিপ্লব রায়। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের সফরসূচি বিশদে প্রকাশ করেন তাঁরা। ৬ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলকাতায় পৌঁছচ্ছেন সরসঙ্ঘচালক। ফিরবেন ১৭ ফেব্রুয়ারি।
এ পার বাংলায় ভাগবতের এই বেনজির দীর্ঘ সফরের সঙ্গে ও পার বাংলার পরিস্থিতির কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি? জবাবে প্রান্ত প্রচার প্রমুখ বিপ্লবের দাবি, ‘‘সরসঙ্ঘচালক এবং সরকার্যবাহের এই সব কর্মসূচি বছরের শুরুতেই স্থির হয়ে যায়। কোথাও কোনও বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণে এই সব সফর নির্ধারিত হয় না।’’ আর ক্ষেত্রীয় প্রচার বিভাগের সহ-প্রমুখ জিষ্ণুর ব্যাখ্যা, ‘‘আরএসএসের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ তিনটি প্রান্ত বা প্রদেশে বিভক্ত— উত্তরবঙ্গ, মধ্যবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ। সরসঙ্ঘচালক কোনও একটি প্রান্তে এত দিন থাকছেন না। দক্ষিণবঙ্গে চার দিন, মধ্যবঙ্গে চার দিন। ঘটনাচক্রে দু’টি প্রান্ত পাশাপাশি হওয়ায় সফরসূচি দেখে মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে একটানা অনেক দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়।’’ কারণ বা ব্যাখ্যা যা-ই হোক, আগে কখনও একটানা এত দিন সরসঙ্ঘচালককে পশ্চিমবঙ্গে থাকতে দেখা গিয়েছে কি? জিষ্ণুর উত্তর, ‘‘না, আমরা তেমন দেখিনি।’’
যে ১১ দিন ভাগবত বঙ্গে থাকছেন, তার পুরোটাই যে দক্ষিণবঙ্গ আর মধ্যবঙ্গকে ভাগাভাগি করে সময় দিতেই চলে যাচ্ছে, এমনও নয়। ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কলকাতায় পৌঁছনোর পর ৭ তারিখ থেকে দক্ষিণবঙ্গের জন্য তাঁর কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। তার মধ্যে থাকছে প্রাদেশিক কর্মসমিতির সঙ্গে বৈঠক, প্রবীণ স্বয়ংসেবক ও প্রচারকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা এবং বিভাগ প্রচারকদের (কয়েকটি জেলা মিলে একটি বিভাগ) সঙ্গে বৈঠক। পরে বর্ধমানে গিয়ে মধ্যবঙ্গ প্রান্তেও ঠিক এই সব কর্মসূচিতেই যোগ দেবেন তিনি। মধ্যবঙ্গে অতিরিক্ত কর্মসূচি বলতে ১৪ ফেব্রুয়ারি মধ্যবঙ্গ আরএসএসের নতুন কার্যালয়ের উদ্বোধন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি তালিতে সাই ময়দানে স্বয়ংসেবকদের প্রকাশ্য সমাবেশে ভাষণ দেওয়া। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে এই কর্মসূচি চলবে ৭ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আর ভাগবত মধ্যবঙ্গে যাবেন ১৩ ফেব্রুয়ারি। তা হলে মাঝের দু’দিন, অর্থাৎ ১১ এবং ১২ ফেব্রুয়ারি কী করবেন সরসঙ্ঘচালক? ওই দু’দিনও ভাগবত কলকাতাতেই (নিউটাউনের অতিথি নিবাসে) থাকছেন। ওই দু’দিনে সঙ্ঘের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক (অখিল ভারতীয় টোলি বৈঠক) হবে। সেই বৈঠকে যোগ দিতে কলকাতায় আসছেন সঙ্ঘের সরকার্যবাহ দত্তাত্রেয় হোসাবলে এবং ছয় সহ-সরকার্যবাহ।
আরএসএসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের দু’দিনব্যাপী বৈঠকও এ বার কলকাতায় হওয়ার বিশেষ কোনও তাৎপর্য নেই? জিষ্ণু এবং বিপ্লবের দাবি, কোনও বিশেষ তাৎপর্য নেই। তাঁদের কথায়, ‘‘টোলি বৈঠকের সময়ও আগে থেকে নির্ধারিত ছিল। দক্ষিণবঙ্গ ও মধ্যবঙ্গের কর্মসূচির মাঝে যে হেতু ওই বৈঠকের তারিখটা পড়েছে, তাই দু’দিনের জন্য আর অন্য কোথাও না গিয়ে এখানেই সরসঙ্ঘচালক টোলি বৈঠক সেরে নিচ্ছেন।’’
কিন্তু সঙ্ঘ মুখপাত্রদের এই ব্যাখ্যা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মানতে নারাজ। কারণ, দক্ষিণবঙ্গের কর্মসূচি শেষ হচ্ছে ১০ ফেব্রুয়ারি, মধ্যবঙ্গের কর্মসূচি শুরু হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। মাঝে অন্তত তিন দিনের ব্যবধান। এই সময়ের মধ্যে নাগপুর বা দিল্লির কার্যালয়ে গিয়ে অখিল ভারতীয় টোলি বৈঠক সেরে ফিরে আসাই যেত। এ রকম যাতায়াত সঙ্ঘে খুব একটা বেনজিরও নয়। তবু তা না-করে কলকাতা তথা বাংলাতেই থেকে যাচ্ছেন ভাগবত।
সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ তাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যা, বাংলাদেশের পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের জনমানসে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে বলে আরএসএস মনে করছে। সেই ‘সুযোগ’কে কাজে লাগাতে সঙ্ঘ নেতৃত্ব সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি রাখতে চান। ভাগবতের বেনজির দীর্ঘ বঙ্গ সফরে অন্যান্য সাংগঠনিক কাজের পাশাপাশি সেই পরিকল্পনাও তৈরি হয়ে যাবে বলে সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ-তাত্ত্বিকদের মত।