সল্টলেক সেক্টর ফাইভে রোজ ভ্যালির দফতরে সিবিআই হানা। নিজস্ব চিত্র। বুধবারই দিল্লি থেকে ফিরে কলকাতা বিমানবন্দরে তাপস পাল (ইনসেটে)। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
সারদার পরে এ বার রোজ ভ্যালি। কেলেঙ্কারির নতুন পাকে জড়িয়ে গেল তৃণমূলের নাম।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের খোঁজে সারদার সঙ্গে অন্যান্য অর্থ লগ্নি সংস্থায় তদন্ত চালানোর কথা সিবিআইয়ের। সেই সূত্রেই বুধবার তারা দেশের ১১টি রাজ্যে রোজ ভ্যালির মোট ৪৩টি অফিসে তল্লাশি চালায়। তার মধ্যে সংস্থার কর্ণধার গৌতম কুণ্ডু এবং জেনারেল ম্যানেজার শিবময় দত্তের বাড়ির পাশাপাশি রয়েছে রয়েছে তৃণমূলের সাংসদ তাপস পালের কলকাতার ফ্ল্যাটও। কিন্তু শুধু তাপস নন, তদন্ত এগোলে দলের অনেক নেতা, সাংসদের নাম উঠে আসতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। আশঙ্কা রয়েছে, উঠে আসতে পারে ডেলো পাহাড়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গৌতম কুণ্ডুর বৈঠকের বিষয়টিও। এর মধ্যেই ইডির কাছে এই বৈঠকের কথা কবুল করেছেন গৌতমবাবু। মুকুল রায়ও সিবিআইয়ের কাছে গিয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন বলে খবর। বিরোধীরা বারবার অভিযোগ করছেন, সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের মতো গৌতমবাবুর সঙ্গেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সেই বিষয়টি আরও এক বার সামনে চলে আসবে বলেই ভয় পাচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
সিবিআইয়ের দাবি, এ দিন গৌতম কুণ্ডু, শিবময় দত্তের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে আটক করা নথিপত্র থেকে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। তবে তৃণমূল যেমন তাপসের বাড়িতে তল্লাশি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি, তেমনই কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি রোজ ভ্যালির কাছ থেকেও।
সারদার বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের মূল অভিযোগ, বেআইনি ভাবে তারা বাজার থেকে টাকা তুলেছে। এবং তা তোলা হয়েছে সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষকে ভুল বুঝিয়ে। কার্যত একই অভিযোগ উঠেছে রোজ ভ্যালির বিরুদ্ধেও। মনে করা হচ্ছে, যে পরিমাণ অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে সারদার বিরুদ্ধে, তার চার গুণ টাকা বাজার থেকে তুলেছে রোজ ভ্যালি। সারদা মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, সমস্ত ধরনের বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত করবে সিবিআই। তার আগেই ওড়িশা পুলিশ সেখানকার সোরো থানায় রোজ ভ্যালির নামে এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছিল। সেই মামলাটিই পরে তুলে দেওয়া হয়েছে সিবিআইয়ের হাতে।
সিবিআইয়ের এক অফিসারের কথায়, “সারদা নিয়ে এত হইচই শুরু হয়েছিল যে, তা নিয়ে তদন্ত চালাতেই আমাদের কয়েক মাস চলে গিয়েছে। বিশাল অঙ্কের টাকার খোঁজ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তাতেও এখন পর্যন্ত পুরো টাকার হদিস মেলেনি। তাই, রোজ ভ্যালির ক্ষেত্রে এত তাড়াহুড়ো করে তদন্তে নামতে আমরা চাইনি। এই সংস্থার বিরুদ্ধেও অনেক তথ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে। এ দিনের তদন্তেও হাতে এসেছে আরও কিছু নথি।”
রোজ ভ্যালি নিয়ে তদন্তে নেমে দেশ জুড়ে তাদের ২৮০৭টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিসও পায় ইডি। সিল করে দেওয়া হয় সেই সব অ্যাকাউন্ট। সূত্রের খবর, সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল হয়ে যাওয়ার পরেও নগদ টাকা দেওয়া-নেওয়া করে পর্যটন ও হোটেল ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছেন গৌতম। ইডির দাবি, এত দিন ধরে তাঁদের করা তদন্তের সমস্ত তথ্য তুলে দেওয়া হয়েছে সিবিআইয়ের হাতে, যার ভিত্তিতে এখন তদন্তে নেমেছে সিবিআই।
জানা গিয়েছে, এ দিন সল্টলেকে ইডির দফতরে গৌতম কুণ্ডুর আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আসেননি। ইডি অফিসারেরা জানান, ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর মোবাইল বন্ধ ছিল। ইডির বক্তব্য, তদন্তে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিলেন গৌতম। কোনও সময় নিজে আসতে না পারলে তাঁর সংস্থার প্রতিনিধিকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু গত কয়েক দিন ইডির তদন্তকারীদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগরাখছেন না তিনি। তাঁর কোনও খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে ইডি সূত্র। তদন্তকারী সংস্থার এক অফিসারের কথায়, “বুধবারই ছিল গৌতমবাবুর হাজিরার শেষ তারিখ। এর পরেও তিনি যদি তদন্তকারীদের ডাকে সাড়া না দেন, তা হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
রোজ ভ্যালি তদন্তের ভার হাতে নিয়েই এ দিন দেশে ছড়িয়ে থাকা সংস্থার বিভিন্ন অফিসে তল্লাশি চালায় সিবিআই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, এ দিন পশ্চিমবঙ্গের ২৭টি জায়গা ছাড়াও ওড়িশা, অসম, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্রিশগড় এবং তামিলনাড়ুর একটি করে জায়গা, ত্রিপুরার সাতটি জায়গায় হানা দেয় সিবিআই। কলকাতায় হানার জন্য মঙ্গলবার থেকেই ওড়িশা, অসম থেকে অফিসারদের নিয়ে আসা হয়েছিল। আবার ত্রিপুরায় হানা দেওয়ার জন্য কলকাতা, গুয়াহাটি, শিলং থেকে অফিসারেরা আগরতলায় পৌঁছোন। বুধবার সকালে কলকাতার সিজিও কমপ্লেক্সে সাত থেকে আট জন করে তদন্তকারী অফিসার এক একটি দল গড়ে বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন ঠিকানায়। সূত্রের খবর, কলকাতা ছাড়াও মেদিনীপুর থেকে মন্দারবনি যেখানেই সংস্থার হোটেল বা অফিস রয়েছে সেখানেই হানা দেওয়া হয়েছে। সংস্থার চেয়ারম্যান গৌতম কুণ্ডুর কলকাতার দু’টি বাড়িতেও হানা দেয় সিবিআই। হানা দেওয়া হয় তাঁর বারাসতের অফিসেও। এ ছাড়াও বাগুইআটির একটি হোটেল, সোনার দোকান, সেক্টর ফাইভের একটি কর্পোরেট অফিস, সাউথ সিটির ফ্ল্যাট-সহ বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চলে। তল্লাশিতে রোজ ভ্যালির বেআইনি আর্থিক লেনদেন সর্ম্পকে প্রচুর তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করেছে সিবিআই। গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, তাপস পাল ও গৌতম কুণ্ডু ছাড়াও সংস্থার এমডি শিবময় দত্ত এবং সংস্থার প্রাক্তন ডিরেক্টর আবীর কুণ্ডু, রামলাল গোস্বামী, অশোক সাহার বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়। সারা দিন ধরে জেরা করা হয়েছে সংস্থার বিভিন্ন স্তরের অফিসারদেরও।
সিবিআইয়ের এই তল্লাশিকে স্বাগত জানিয়েছেন সংস্থার অল ইন্ডিয়া ফিল্ড ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “সমস্ত সংস্থা (চিটফান্ড)-র বিরুদ্ধে তদন্ত করার দাবি আমরা ২০১৩ সালেই করেছিলাম। এই দাবি জানিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে চিঠিও লিখেছিলাম। অন্য সংস্থাগুলি বেআইনি কাজ করছিল বলে আমাদের বদনাম হচ্ছিল। আমাদের টাইমস শেয়ারের ব্যবসা আইনত।
সেখানে পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। তদন্ত হলে আসল তথ্য বেরিয়ে পড়বে।” সিবিআইয়ের এই তদন্তে কর্মীরা সব ধরনের সহযোগিতা করবেন বলেও এ দিন অমিতবাবু জানান।