মুকুল রায় এবং দিলীপ ঘোষ। -ফাইল চিত্র।
বিধানসভা ভোট পরবর্তী বাংলা আপাতত সরগরম স্বাস্থ্য রাজনীতি নিয়ে। আরও ভাল করে বললে বিজেপি বিধায়ক মুকুল রায়ের স্ত্রী-র গুরুতর অসুস্থতা এবং তার বিভিন্ন নেতার হাসপাতাল-সফরের কারণে। সেই আবহেই আরও একবার প্রকট হয়ে প্রকাশ্যে এল বিজেপি-র সর্ব ভারতীয় সহ-সভাপতির সঙ্গে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সম্পর্কের শৈত্য। মুকুল-দিলীপ যে একে অপরের বিরাট গুণমুগ্ধ নন, তা ইতিমধ্যে বিজেপি তো বটেই, অন্য রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরাও জানেন। রাজ্য রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালরাও তা জানেন না, এমন নয়। কিন্তু মুকুলের স্ত্রী-র গুরুতর অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে তা এ বার একেবারে প্রকাশ্যেই চলে এসেছে। তাঁর অসুস্থ স্ত্রী-কে দেখতে দিলীপের হাসপাতাল-সফর নিয়ে প্রকাশ্যেই অনীহা দেখিয়ে ফেললেন মুকুল। বললেন, ‘‘উনি আমাকে বা অন্য কাউকে বলে তো হাসপাতালে যাননি। কাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তা-ও আমি জানি না!’’
তবে এরই পাশাপাশি মুকুল বলেছেন, ‘‘কেউ অসুস্থ হলে কেউ তাঁকে দেখতে যেতেই পারেন। তাতে কোনও অসুবিধা নেই। এর মধ্যে রাজনীতি দেখাও অনুচিত হবে।’’ প্রসঙ্গত, দিলীপ যে হাসপাতালে যাচ্ছেন, তা সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয় তার অব্যবহিত আগে।
মুকুল যতই বলুন, রাজনীতি দেখা বুধবার থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। দলের একাংশের অনুমান, দিলীপের হাসপাতালে মুকুল-জায়াকে দেখতে যাওয়ার পিছনে কাজ করেছে ‘অভিষেক ভাইরাস’। যখন আচমকাই মুকুলের স্ত্রী-কে দেখতে বাইপাসের ধারের হাসপাতালে চলে যান তৃণমূলের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সফর এতটাই আকস্মিক ছিল যে, তার অভিঘাতে গোটা রাজ্য রাজনীতিই খানিক হকচকিয়ে যায়। সেই অভিঘাত গিয়ে পড়ে বিজেপি-র উপরেও। কারণ, তার পরেই তড়িঘড়ি দিলীপের হাসপাতাল-সফরের সূচি প্রকাশ্যে আনা হয়। এহ বাহ্য, তার পর দিন সকালে মুকুলকে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁরও উদ্দেশ্য একই— মুকুলের স্ত্রী-র অসুস্থতার খোঁজ নেওয়া। অথচ, গত ১৪ মে থেকে হাসপাতালে ভর্তি মুকুল-জায়াকে দলের কেউ দেখতে গিয়েছেন বা কোনও উচ্চ স্তরের নেতা ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন বলে বিজেপি-র নেতারাই মনে করতে পারছেন না।
স্পষ্টতই অভিষেকের ঝটিকা হাসপাতাল-সফর বিজেপি-কে ‘অস্বস্তি’-তে ফেলেছে। কারণ, কয়েক বছর আগে অভিষেকের সঙ্গে অবনিবনার কারণেই মুকুল তৃণমূল ছেড়েছিলেন বলে খবর রটেছিল। যদিও কোনও পক্ষই তা স্বীকার করেনি। কিন্তু মুকুল-অভিষেকের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে, এমন কোনও খবর ছিল না। তবে অভিষেকের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার পর থেকে ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে মুকুল খানিকটা পিছিয়েই গিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, এর মধ্যেই ভোটের প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুকুলের প্রতি ‘সহানুভূতি’ জানান। তিনি বলেন, ‘‘মুকুলটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। ও তো শুভেন্দুর মতো অত খারাপ নয়। কিন্তু ওকেও একটা দূরের সিট (কৃষ্ণনগর উত্তর) দিয়েছে। বাড়ির কাছে সিট দিতে পারত!’’ তার পর অভিষেকের আচমকা মুকুলের স্ত্রী-কে দেখতে যাওয়ার মধ্যে ‘পরিণত রাজনীতি’র ছোঁয়া দেখতে পাচ্ছেন ওয়াকিবহালরা। সেটাও এমন একটা সময়ে, যখন মুকুল নিজেও খুব ‘স্পর্শকাতর’ অবস্থায় রয়েছেন।
ভোটে মুকুল সেই কৃষ্ণনগর উত্তর আসন থেকেই জিতে বিধায়ক হয়েছেন। কিন্তু লোকসভা ভোটে বিজেপি-র ওই আসনে জয়ের ব্যবধান অন্তত ১৮ হাজার কমেও গিয়েছে। ভোটের পর রাজনীতিক হিসেবে মুকুল নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন। বিধানসভায় এসে বিধায়কপদে শপথ নেওয়া ছাড়া তাঁকে সে ভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে দেখা যায়নি। ইদানীং তাঁর শরীরও ভাল যাচ্ছে না। সস্ত্রীক কোভিডে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি রাজনৈতিক এবং ব্যবহারিক জীবনেও অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব রচিত হয়েছে বললে সম্ভবত বাড়াবাড়িই হবে। কিন্তু কোথাও যে একটা বেসুর বাজছে, তা মুকুলের ঘনিষ্ঠরাও জানেন। সেই প্রেক্ষিতেই অভিষেকের তাঁর স্ত্রী-কে দেখতে যাওয়া। ঘটনাচক্রে, বুধবার সন্ধ্যায় যখন অভিযেক হাসপাতালে যান, তখন মুকুল সেখানে ছিলেন না। ছিলেন তাঁর পুত্র তথা রাজ্যের প্রাক্তন বিধায়ক শুভ্রাংশু। তাঁর সঙ্গে অভিষেকের বেশ খানিকক্ষণ কথাও হয়। এ-ও এক ঘটনাচক্রই যে, তার কয়েক ঘন্টা আগেই অভিষেককে ‘নাবালক’ বলে আক্রমণ করেন শুভেন্দু। যার জবাব বৃহস্পতিবার অভিষেক দিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরে দাঁড়িয়েই। বলেছেন, ‘‘সাবালকের ব্যর্থতা দেখতে নাবালককেই আসতে হয়। আর নাবালককে কিন্তু কেউ খবরের কাগজে জড়িয়ে টাকা নিতে দেখেনি!’’ স্পষ্টতই অভিষেকের ইঙ্গিত ছিল নারদা কেলেঙ্কারির দিকে।
অভিষেকের সফরে রাজনীতি দেখতে চাননি মুকুল। অভিষেক নিজেও বলেছেন, মুকুলের স্ত্রী তাঁর ‘মাতৃসমা’। এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই। কিন্তু অভিষেকের সফর নিয়ে আপ্লুত শুনিয়েছে শুভেন্দুর দলীয় সতীর্থ শুভ্রাংশুকে। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ‘‘আমাদের দলের কেউ (দিলীপ) দেখতে এলে বা প্রধানমন্ত্রী বাবাকে ফোন করলেও তাঁরা আমাদেরই দলের নেতা। কিন্তু অভিষেক তো বিরোধী রাজনীতিক মানুষ। ও যে দৃষ্টান্ত তৈরি করল, তা অভূতপূর্ব। ও ছোট থেকে মা’কে দেখেছে। কাকিমা বলে ডাকে। তাই মায়ের গুরুতর অসুস্থতার কথা শুনে দেখতে চলে এসেছে।’’ এ-ও এক ঘটনাচক্রই যে, তার আগেই মুকুল-তনয়ের ফেসবুক পোস্টে দেখা গিয়েছে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের সমালোচনা না করে ‘আত্মসমালোচনা’-র পরামর্শ। যা একান্ত ভাবেই বিজেপি-র নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক লাইনের পরিপন্থী। তিনি কি তা হলে তৃণমূলে যোগ দেবেন? শুভ্রাংশু বলেছেন, ‘‘আগে আমার মা’কে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই। তার পর ও সব ভাবা যাবে।’’ অর্থাৎ, তৃণমূলে ফেরার বিষয়ে ‘হ্যা’ না-বললেও ‘না’-ও বলেননি বীজপুরের প্রাক্তন বিধায়ক। তার মধ্যেই আবার প্রকাশ্যে এসে পড়েছে মুকুল-দিলীপ শৈত্য। যা থেকে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ খুঁজছেন রাজনীতির কুশীলবেরা।