গ্রাফিক্স শৌভিক দেবনাথ
দু’জনেই সাংসদ। এটুকু ছাড়া দিলীপ ঘোষ আর বাবুল সুপ্রিয়র মধ্যে মিল খোঁজা মুশকিল। রাজ্য বিজেপি-ই শুধু নয়, বাংলার রাজনৈতিক মহলও জানে যে বরাবর দুই মেরুতে অবস্থান মেদিনীপুর ও আসানসোলের সাংসদের। নানা বিষয়ে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন দু’জনে।
একজন এসেছেন সঙ্ঘ পরিবারের মূল স্রোত থেকে। আর একজন একেবারে ভিন্ন মেরুর বিনোদন জগৎ থেকে। রাজনীতিতে সহাবস্থান ছ’বছরের। সুপ্রিয় বড়াল থেকে গায়ক বাবুল সুপ্রিয় হয়ে ওঠার অনেক পরে রাজনীতি। ২০১৪ সালে বিজেপি-তে যোগ দেন বাবুল। দীর্ঘ দিন সঙ্ঘ প্রচারক থাকার পরে তার পরের বছর ২০১৫ সালে দিলীপের রাজনীতিতে পদার্পন। সেই বিচারে দিলীপের থেকে রাজনীতিতে এক বছর এগিয়ে বাবুল। তবে পদাধিকারে তিনিই যে বড়, তা গত ছ’বছরে বারবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুলকে বুঝিয়ে গিয়েছেন রাজ্য সভাপতি দিলীপ।
মতের মিল হয়েছে হাতে গোনা কয়েক বার। ইদানীংকালে দু’টি প্রসঙ্গে। গত ডিসেম্বরে তৎকালীন পাণ্ডবেশ্বরের তৃণমূল বিধায়ক বিজেপি-তে যোগ দিতে পারেন শুনেই বিরোধিতায় প্রকাশ্যে সরব হয়েছিলেন বাবুল। সমর্থন করেছিলেন দিলীপ। যদিও পরে কারও কথাই গুরুত্ব পায়নি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে।
এর পরে ‘ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস’ নিয়ে দিলীপের স্বীকারোক্তি, ‘কর্মীদের নিরাপত্তা দিতে আমরা ব্যর্থ’কে সমর্থন জানিয়েছিলেন বাবুল।
বাকি সব কিছুতে অমিল আর অমিল। এমনকি, এক বার কলকাতায় একটি গোমূত্র পানের কর্মসূচিকে দিলীপ সমর্থন করায় উল্টো সুরে বিরোধিতা করেছিলেন বাবুল। দিলীপের ‘লাগামহীন’ বক্তব্য প্রসঙ্গে টেলিভিশন বিতর্কে দিলীপ-বাবুল মতবিরোধ প্রকাশ্যে চলে এসেছিল।
ফাইল চিত্র।
তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রদবদলের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। বাবুল নেটমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছি। ইস্তফা দিতে (আস্ক টু রিজাইন) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা সঠিক পদ্ধতি না-ও হতে পারে।’ দিলীপ-শিবিরের একাংশের বক্তব্য ছিল, আসানসোলের বিজেপি সাংসদ তাঁর ওই পোস্টে প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাজের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর পরেই দিলীপ সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন, ‘‘তাঁকে (বাবুল) যদি স্যাক (বরখাস্ত) করা হত, তা হলে কি ভাল হত? পদ্ধতি মেনে হয়েছে। আপনি পদ ছেড়ে দিন, অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। আপনাকে অন্য কাজে লাগানো হবে। সবাই তাই করেন। ১২ জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। কেউ তো এমন লেখেনি? কাজের প্রতি আস্থা রাখা উচিত। পার্টির কাজ করছি, বিধায়ক সাংসদ যা হয়েছি, তা পার্টির জন্য।’’
বাবুল যার পাল্টা ফেসবুকে লেখেন, ‘রাজ্য সভাপতি হিসেবে মনের আনন্দে দিলীপদা অনেক কিছুই বলেন|’ আরও লেখেন, ‘উনি রাজ্য সভাপতি— সবার শ্রদ্ধার পাত্র! আমিও আন্তরিক শ্রদ্ধা জানালাম প্রিয় দিলীপদাকে।’ এর পরে আবার সংবাদমাধ্যমকে দিলীপ বলেন, ‘‘আমরা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম। কাজে লাগেনি। পার্টির স্বার্থের থেকে যখন ব্যক্তিগত স্বার্থ বড় হয়, তখন সমস্যা তৈরি হয়। পার্টি যাদের উপর ভর করে এগিয়েছিল তারা আছে, সে ভাবেই পার্টি এগোবে।’’
বাবুল তৃণমূলের টুইটার হ্যান্ডল ফলো করতে শুরু করলেও কটাক্ষ করেন দিলীপ। বলেন, “ফলো কেউ কাউকে করতেই পারেন। টুইটারে ফলো করা ভাল। অন্য রকম ফলো না করাই ভাল।” ঘটনাচক্রে, তখন আসানসোলে জেলার সাংগঠনিক বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন দিলীপ। সেখানে ছিলেন না বাবুল। যে প্রসঙ্গে দিলীপ বলেছিলেন, “উনি সব মিটিংয়ে থাকেন না। আমিও এসেছি অনেক বার। ওঁকে পাইনি। মন্ত্রিত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এ বার হয়তো থাকবেন আমাদের সঙ্গে। আমাকে ডাকা হয়েছে। আমি এসেছি।”
শনিবার বাবুল সরাসরি দিলীপের কথা না লিখলেও তাঁর রাজনৈতিক সন্ন্যাস ঘোষণার ফেসবুক পোস্টে রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর বনিবনা না হওয়ার কথা লিখেছেন। এটাও জানিয়েছেন যে, এই গোলমাল দলের ক্ষতি করছিল। তবে দিলীপ শনিবারও বাবুল সম্পর্কে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। সাংবাদিক বৈঠকে দিলীপ বলেছেন, ‘‘আমি ফেসবুক, টুইটার দেখি না। উনি কি ইস্তফা দিয়ে দিয়েছেন? খোঁজ নিন।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘কে কোথায় যাচ্ছেন, আমি তা নিয়ে কেন বলব? রাজনীতিতে আসা বা ছেড়ে দেওয়া কারও ব্যক্তিগত বিষয়। আমি কিছু বলব না।’’ কিন্তু সেখানেই থামেননি দিলীপ। বেশ ব্যঙ্গের সুরেই বলেছেন, ‘‘মাসির গোঁফ হলে মাসি বলব না মেসো বলব তা ঠিক করব। আগে তো মাসির গোঁফ হোক।’’
বিজেপি শিবিরে অনেকের পর্যবেক্ষণ, বাবুলের সিদ্ধান্ত জানার পরে দিলীপকে দৃশ্যতই খানিক খুশি খুশি দেখিয়েছে। বাবুল অবশ্য সরাসরি দিলীপ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেননি। অন্তত শনিবার রাত পর্যন্ত। তাঁর বক্তব্য, ‘’আমার যা বলার লিখে দিয়েছি। আমি আমার সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে চাই। আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’ তবে বাবুলের হিতৈষীদের
বক্তব্য, ‘’এইসমস্ত আলটপকা এবং বোকা বোকা মন্তব্যের জন্যই লোকে বিজেপি ছেড়ে চলে যাচ্ছে!’’
তবে বাবুলের যা রেকর্ড, তাতে তিনি একেবারে নীরব থাকবেন কিনা, তা বলা কঠিন। দলে থাকাকালীনও তিনি দিলীপকে কটাক্ষ করেছেন। আর এখন তো তিনি ‘অলবিদা মোড’-এ।