landslide

Landslide: জল নামলে কী হবে, চিন্তা খনি এলাকায়

ইসিএলের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রানিগঞ্জ, আসানসোল-সহ খনি এলাকায় প্রায় ৭৫৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে মোট ১০টি ‘ভূগর্ভস্থ আগুনপ্রবণ’ এলাকা আছে।

Advertisement

সুশান্ত বণিক ও নীলোৎপল রায়চৌধুরী

আসানসোল ও রানিগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২১ ০৭:৫৩
Share:

ইসিএলের কয়লা কাটা হয় যেখানে, সেখানে এ পর্যন্ত চিহ্নিত কোনও ‘ফায়ার জ়োন’ নেই। প্রতীকী ছবি।

দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন গিলছে মাটির নীচের কয়লার স্তর— পশ্চিম বর্ধমানের বিস্তীর্ণ কয়লা শিল্পক্ষেত্রে এ ছবি অচেনা নয়। কিন্তু বৃষ্টি পড়লেই আতঙ্কের প্রহর গনেন বাসিন্দারা। কারণ, তাঁদের চিন্তা জল ও মাটির নীচের আগুনের যৌথ কারণে ধস আরও ত্বরান্বিত হবে না তো! মাটি ফাটার চেনা শব্দের সঙ্গে তলিয়ে যাবে না তো ঘরবসত, জমি-জায়গা! সে আতঙ্ক থেকে অনেক ক্ষেত্রে জোরালো হয়েছে পুনর্বাসনের দাবি।

ইসিএলের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রানিগঞ্জ, আসানসোল-সহ খনি এলাকায় প্রায় ৭৫৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে মোট ১০টি ‘ভূগর্ভস্থ আগুনপ্রবণ’ এলাকা আছে। শাঁকতোড়িয়া, অমৃতনগর, জেকে নগর, নিমচা, জামবাঁধ, শঙ্করপুর, ডালুরবাঁধ এবং বনজেমাহারি, শঙ্করপুর ও রসুনপুরে। পাশাপাশি, খনি এলাকায় প্রায় ৮৬৩ হেক্টর এলাকা জুড়ে রয়েছে ১৩৯টি ধসপ্রবণ এলাকা। ‘ডিরেক্টর জেনারেল অব মাইনস সেফটি’র (ডিজিএমএস) সমীক্ষা অনুযায়ী, এই আগুনপ্রবণ এবং ধসপ্রবণ এলাকাগুলি মিলিয়ে মোট ১৪৯টি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত। এই সমস্ত এলাকাগুলিতে বিপদের আশঙ্কা বেশি। তেমনই একটি এলাকা কালীপাহাড়ির এজেন্ট কলোনি এলাকার বাসিন্দা বিনোদ প্রসাদ বলেন, “বর্ষার জলে এমনিতেই প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। এ বার যদি ধস নামে, তা হলে আর রক্ষা নেই!”

Advertisement

এই আতঙ্ক অমূলক নয়। কারণ, খনি বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃষ্টির সঙ্গে এই আগুন ও ধসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন— প্রথমত, বর্ষায় মাটির তলার ফাঁপা অংশে জল ঢুকলে মাটির উপরি ভাগ ভেসে ওঠে। তাই ঘোর বর্ষায় (‌‌‌‌যেমন হয়েছে সম্প্রতি। আসানসোলে রেকর্ড ৪৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত) ধস নামে না। কিন্তু রোদ ওঠার পরে জল শুকোতে থাকে। এর ফলে, মাটির তলা ফের ফাঁপা হয়ে যেতে পারে। আবার মাটির উপরের অংশও শুকোতে থাকে। এই অবস্থায় মাটির উপরের অংশ ক্রমশ নীচের দিকে নামতে থাকে এবং ধস নামে। অতীতে, ডিসেরগড়, সাঁকতোড়িয়া, জামুড়িয়ার নন্ডী, বারাবনির ভানোড়া, সালানপুরের সামডি-সহ কিছু এলাকায় এই কারণে ধস নেমেছিল।

দ্বিতীয়ত, ভূগর্ভে যেখানে আগুন জ্বলছে, সেখানে জল ঢুকলে, আগুন সাময়িক ভাবে অনেক সময় নিভে যায়। কিন্তু কয়লার স্তরে মিথেন ও কার্বন মনোক্সাইড থাকে। রোদ ওঠার পরে, জল কমতে শুরু করে। মাটির তলায় বিভিন্ন ছিদ্র দিয়ে জল বেরোতে থাকে। পরে, এই ছিদ্রগুলি দিয়ে অক্সিজেন ভূগর্ভে ঢুকে ওই মিথেন ও কার্বন মনোক্সাইডের সংস্পর্শে এসে ফের আগুন ধরে। তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। ধসে জনজীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নিমচা, জেকে নগর, বারাবনির রসুনপুর, সামডি, সাঁকতোড়িয়ায় এই ঘটনা ঘটেছিল বলে শ্রমিক নেতাদের দাবি।

Advertisement

তৃতীয়ত, ভূগর্ভস্থ বা খোলামুখ খনিতে পড়ে থাকা কয়লা অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে লাগাতার তাপের ফলে (‘স্পন্টেনিয়াস হিটিং’) আগুন ধরে যায়। তখন এই অংশটিকে ‘ফায়ার জ়োন’ বলা হয়। এই ‘ফায়ার জ়োন’ জলের সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভবনা থাকে। সে ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠে ফাটল, ধস নেমে লাগোয়া জনপদ বিপন্ন হতে পারে। ইসিএলের উদ্ধারকারী দলের প্রাক্তন কর্মী অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমার কর্মজীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে বিষয়টি শুনেছি।”

ইসিএলের কয়লা কাটা হয় যেখানে, সেখানে এ পর্যন্ত চিহ্নিত কোনও ‘ফায়ার জ়োন’ নেই। দেশের কয়লা-ক্ষেত্রে এমন বিস্ফোরণের একমাত্র নথিভুক্ত ঘটনাটি ঘটেছিল, মহানদী কোলফিল্ড লিমিটেডের জগন্নাথ খোলামুখ খনিতে। যদিও শ্রমিক সংগঠনগুলির দাবি, নিমচায় জাতীয়করণের আগে ভূগর্ভস্থ খনিতে আগুন ধরেছিল। সিটুর জেলা সম্পাদক বংশগোপাল চৌধুরীর অভিযোগ, “নিমচায় শুধুমাত্র ভূপৃষ্ঠের উপরের ফাটলগুলি ভরাট করা হয়েছে। তাই এই এলাকা পুরোপুরি ভাবে সুরক্ষিত, বলা যায় না। ফলে, ভূগর্ভের তলায় থাকা আগুনের সঙ্গে কোনও ভাবে নতুন ফাটল দিয়ে অপর্যাপ্ত জল ঢুকলে বিপত্তির আশঙ্কা রয়েছে।” ইসিএল যদিও এই অভিযোগ মানেনি।

এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার উপায় কী তা? পশ্চিম বর্ধমানের জেলা বিপর্যয় ব্যবস্থাপন দফতরের নোডাল অফিসার তথা এগজ়িকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তমোজিৎ চক্রবর্তী বলেন, “ইসিএলের উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে কথা বলে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে ধস বা ভূগর্ভস্থ আগুন মোকাবিলা করার মতো পরিকাঠামো আমাদের হাতে নেই। তাই এ ক্ষেত্রে ইসিএল-কে সাহায্য করি আমরা।”

ইসিএলের মাইনস রেসকিউ বিভাগের সুপারিন্টেন্ডেন্ট অপূর্ব ঠাকুর বলেন, “এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে, প্রাথমিক ভাবে বর্ষার পরেই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে মাটি ভরাট করতে হয়। সে কাজ এ বারেও করা হবে।” একই কথা জানান ডিজিএমএস-এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আধিকারিক। আইএনটিইউসি অনুমোদিত কোলিয়ারি মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, খনিতে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা কয়লায় নিয়মিত রাসায়নিক ও জল ছড়ানো দরকার। সে কাজও নিয়মিত করা হয় বলে ইসিএলের দাবি। পাশাপাশি, ১৪৯টি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জনবসতিকে পুনর্বাসন দেওয়ার কাজ চলছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement