পুরুলিয়ার একটি বুথে নিরাপত্তায় পুলিশ। ফাইল চিত্র
বড়সড় রদবদল হল পুরুলিয়া জেলা পুলিশে। আগেই বদলি হয়েছেন পুলিশ সুপার। এ বার ডিএসপি পদমর্যাদার দুই আধিকারিক-সহ বদলির নির্দেশ এল জেলার তিন ইনস্পেক্টর ও দুই ওসির।
সোমবারই ঝাড়গ্রাম জেলার আট বিডিওকে বদলি করা হল। দায়িত্বে আসেন নতুন জেলাশাসকও। ঝাড়গ্রামের মতোই এ বার পঞ্চায়েত ভোটে পুরুলিয়ার অনেক জায়গাতেই বিজেপির পদ্ম ফুটেছে। ঝাড়গ্রামের কিছু বিডিও-র মতোই পুরুলিয়ার কিছু পুলিশ আধিকারিককেও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বদলি করায় অন্যরকম তাৎপর্য খুঁজে পাচ্ছেন কেউ কেউ।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার সন্ধ্যায় বদলির নির্দেশ জারি হয়েছে। বদলির নির্দেশ এসেছে এসডিপিও (রঘুনাথপুর) অভিজিৎ চৌধুরী, পুরুলিয়ার ডিএসপি (সদর) সুব্রতকুমার পালের। ওই তালিকায় রয়েছেন ঝালদা থানার আইসি ত্রিগুণা রায়, বরাবাজার থানার আইসি সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, সাঁওতালডিহি থানার আইসি প্রশান্ত পাত্র। একই সঙ্গে বদলি করা হচ্ছে হুড়া থানার ওসি রামগোপাল পাল ও মানবাজারের ওসি আদিত্যপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও।
ঘটনাচক্রে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে পুরুলিয়ার যে সব এলাকায় শাসকদলের বিপর্যয় ঘটেছে, ওই আধিকারিকদের অনেকেই সেই সময়ে ওই সব এলাকার দায়িত্বে ছিলেন। সে কারণেই বদলি নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। যদিও জেলা পুলিশের তরফে এ নিয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব পুলিশকে সঙ্গে নিয়েই ভোটে বিজেপিকে হারানোর চেষ্টা করেছিল। এমনকী ভোটের পরেও বিজেপির জয়ী সদস্যদের ভাঙিয়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্যও পুলিশকে দিয়ে চাপে ফেলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। যে সব আধিকারিক এই অনৈতিক কাজে রাজি হননি, তাঁদের উপরেই বদলির কোপ পড়েছে।’’ যদিও জেলা পুলিশের এই বদলির সঙ্গে তাঁদের দলের কোনও সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন মন্ত্রী তথা তৃণমূলের পুরুলিয়া জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো। তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘পুরুলিয়ায় জেলা পুলিশের এই বদলি সম্পূর্ণ ভাবে পুলিশের নিজস্ব বিষয়। এর সঙ্গে আমাদের দলের কোনও সম্পর্ক নেই।”
সরলেন
অভিজিৎ চৌধুরী ।এসডিপিও (রঘুনাথপুর)
সুব্রতকুমার পাল।ডিএসপি (পুরুলিয়া সদর)
আনন্দজিৎ হোড়ে।এসডিপিও (খাতড়া)
ত্রিগুণা রায়।আইসি (ঝালদা থানা)
সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ।আইসি (বরাবাজার থানা)
প্রশান্ত পাত্র।আইসি (সাঁওতালডিহি থানা)
মণিময় সিংহ রায়।আইসি (রাইপুর)
অমিত নন্দী।আইসি (বারিকুল)
রামগোপাল পাল।ওসি (হুড়া থানা)
আদিত্যপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ।ওসি (মানবাজার)
ঘটনা হল, শুধু বিজেপিই নয়, কংগ্রেস থেকে সিপিএম নেতৃত্ব বারবার দাবি করেছেন, পুলিশকে দিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাঁদের জেতা সদস্যদের তৃণমূলে যোগ দেওয়ার চাপ দিচ্ছে তৃণমূল। এক কদম বাড়িয়ে বিজেপি নেতৃত্ব দাবি করেছেন, যুব তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা জেলার বিভিন্ন পুলিশ আধিকারিকদের দলের কথা মতো না চললে সটান উত্তরবঙ্গে বদলি করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। সেটাই এ বার হল।
ঘটনাচক্রে, বদলি হওয়া সাত আধিকারিকের মধ্যে পাঁচ জনকেই পাঠানো হয়েছে উত্তরবঙ্গে। রঘুনাথপুরের এসডিপিও অভিজিৎবাবুকে বদলি করা হয়েছে কালিম্পংয়ে। বদলি হওয়া আইসিদের অপেক্ষাকৃত অনেকটাই কম গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। বরাবাজার ও সাঁওতালডিহির আইসিকে পাঠানো হয়েছে যথাক্রমে মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় মিসিং পার্সন ব্যুরোয়। ঝালদার আইসিকে বদলি করা হয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে। হুড়া ও মানবাজার এই দুই থানার ওসিদের বদলি হয়েছে যথাক্রমে মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুরে। তাঁদের আপাতত কোনও থানার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সাধারণত ওসিদের বদলি হয় একই জেলার অন্য কোনও থানা বা বড়জোর পাশের জেলার থানায়। এ ক্ষেত্রে পুরুলিয়ার দুই ওসির বদলি একেবারে উত্তরবঙ্গের দুই জেলায় হওয়ায় জোর চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। পুলিশ কর্মীদের অনেকেই জানাচ্ছেন, ওসিদের ক্ষেত্রে সাধারণত বদলির নির্দেশ জারী করেন জেলা পুলিশ সুপার। কিন্তু হুড়া ও মানবাজারের ওসিদের ক্ষেত্রে বদলির নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিআইজি (প্রশাসন) প্রণবকুমার দাস।
পুলিশ কর্মীদের অনেকেই জানাচ্ছেন, পঞ্চায়েত ভোটের ফল প্রকাশের কিছু দিনের মধ্যে বলরামপুরে দুই বিজেপি কর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরেই পুলিশ সুপারের পদ থেকে জয় বিশ্বাসকে রাতারাতি সরিয়ে দেওয়া হয়। তখনই পুলিশ কর্মীদের অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, আরও অনেকেরই একই পরিণতি অপেক্ষা করছে।
রঘুনাথপুর মহকুমার ছ’টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে চারটিতে ভরাডুবি হয় শাসকদলের। আর বদলি হয়েছেন রঘুনাথপুরের এসডিপিও। পুলিশ আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, সাধারণত দু’বছর পরে এসডিপিওদের বদলি করা হয়। কিন্তু, তার অনেকটা আগেই বদলি হলেন অভিজিৎবাবু। রঘুনাথপুরের দায়িত্বে আসছেন রাজ্য পুলিশের অপরাধ দমন শাখার ডিএসপি সত্যব্রত চক্রবর্তী। তিনি অবশ্য রঘুনাথপুরের বিভিন্ন এলাকা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। পদোন্নতির আগে তিনি কাশীপুরের সিআই-সহ রঘুনাথপুরের কয়েকটি থানায় ওসির দায়িত্ব সামলেছেন।
একই ভাবে ঝালদা এলাকায় তৃণমূলের ফল খারাপ হয়েছে। আর বদলি হয়েছেন ঝালদা থানার আইসি। ঝালদায় দু’টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে একটিতেও জিততে পারেনি তৃণমূল। বরাবাজারেও ভাল ফল হয়নি তৃণমূলের। এখানে পঞ্চায়েত সমিতির ২৮টি আসনের মধ্যে মাত্র একটি আসনে এগিয়ে আছে তৃণমূল। বেশ কিছু পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়েছে শাসকদলের।
সাঁওতালডিহির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। রঘুনাথপুর ২ ব্লক ও পাড়া ব্লকের একাংশ পড়ে সাঁওতালডিহি থানার আওতায়। ওই দুই পঞ্চায়েত সমিতি হাতছাড়া হয়েছে তৃণমূলের। হুড়ার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। নির্বাচনের আগে এখানে বিজেপির হাতে মার খাওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন তৃণমূল কর্মীরা। নির্বাচনে কয়েকটি পঞ্চায়েতও হেরেছে শাসকদল।
আর মানবাজারের ওসি আদিত্যপ্রসাদবাবুর পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে বলরামপুর থানার ওসি ছিলেন। বলরামপুরে তৃণমূলের ভরাডুবি হওয়ার পরেই রাতারাতি আদিত্যপ্রসাদবাবুকে সরিয়ে দেওয়া হয় মানবাজার থানায়। এ বার সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হল উত্তরবঙ্গে।
বদলি-পর্ব কি এখানেই শেষ?— প্রশ্ন জেলা পুলিশের অনেকের।