রামচন্দ্রপুরের সন্ধ্যা চেয়েছিল, হাসপাতালের নার্স হতে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েটিকে স্কুলের দিদিমণিরা জানিয়েছিলেন, তার জন্য অন্তত উচ্চমাধ্যমিকটা পাশ করা দরকার।
রাজ্যের একেবারে উত্তর প্রান্তে বীরপাড়া চা বাগানের শ্রমিক মহল্লায় আশা ছেত্রী রামচন্দ্রপুরের সন্ধ্যাকে না চিনলেও একই ভাবে চেয়েছিল পড়াশুনো শেষ করে চা বাগানের স্কুলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতে।
কিন্তু, দারিদ্র এক রেখায় মিলিয়ে দিয়েছে রাজ্যের উত্তর আর দক্ষিণ প্রান্তের দুই কিশোরীকে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনো চালিয়েও তার পর আর তাদের সুযোগ হয়নি স্কুলে যাওয়ার। সন্ধ্যা আর আশা, দু’জনকেই লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দিদিরা পাশে না দাঁড়ালে হয়ত ওদেরকেও তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ঢুকে পড়তে হত সংসারে। কিন্তু, কপাল ভাল, বছর দু’য়েক নষ্ট হওয়ার পর ফের ওরা ভর্তি হতে পেরেছে স্কুলে। একটু বেশি বয়সে হলেও দু’জনেই মাধ্যমিকের বেড়া টপকেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, শিক্ষার আওতায় রাজ্যের মেয়েদের সামিল করাটা, বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এখনও বেশ বড় একটা সমস্যা। একেবারে সাম্প্রতিক সরকারি নথি থেকে জানা যাচ্ছে, প্রাথমিক ও উচ্চতর প্রাথমিক স্তরের স্কুলগুলিতে মেয়েদের ভর্তির হার যথাক্রমে ৯১ ও ৮২ শতাংশ হলেও মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছে তা আচমকাই নেমে আসছে ৫০ শতাংশে। আর, উচ্চমাধ্যমিকের অবস্থাটা আরও করুণ। ওই স্তরে মেয়েদের স্কুলে ভর্তির হার মাত্রই ৩২.৭ শতাংশ।
এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, নিচু ক্লাসে ভর্তি নিয়ে সমস্যা না থাকলেও উঁচু ক্লাসে পৌঁছে পরিস্থিতিটা পাল্টে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ডাইস’ (২০১৪-’১৫) সমীক্ষা বলছে, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, বয়সভিত্তিক স্কুলে ভর্তির (নেট এনরোলমেন্ট রেশিও বা, এনইআর) হারে দেশের সব রাজ্যই কম-বেশি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর মানে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের সব রাজ্যেই মেয়েদের অন্তত প্রাথমিক স্তরের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলেও শিক্ষাজীবনের শেষ পর্যন্ত তাদের স্কুলে ধরে রাখা যাচ্ছে না। তারা স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে। স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
গত কয়েক বছরে প্রাথমিক ও উচ্চতর প্রাথমিক স্তরের স্কুলগুলিতে মেয়েদের ভর্তি হওয়ার হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। এই রাজ্যের ক্ষেত্রে শতাংশের হিসেবে, সেটা যথাক্রমে ৯১ ও ৮২ শতাংশ। সারা দেশে তা দু’টি স্তরেই ৮৯ শতাংশ। কিন্তু, মাধ্যমিক স্তরে গিয়ে তা অনেকটাই কমে আসছে। আর তা কমছে খুব দ্রুত হারে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যেটা মাত্র ৫০ শতাংশ, সারা দেশের ক্ষেত্রে তা আরও কম।
কেন এমনটা হচ্ছে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‘এর একটা বড় কারণ, শিক্ষার অধিকার আইনে (২০০৯) উল্লিখিত বয়স সীমা। শিক্ষার অধিকার আইনে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের অবৈতনিক শিক্ষা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। অথচ, তার পরবর্তী স্তরে এমন কোনও আইনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি, যা শিক্ষাকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য আবশ্যিক করে তুলতে পারে।
একটি সর্বভারতীয় শিশু অধিকার রক্ষা সংগঠনের পলিসি রিসার্চ ও অ্যাডভোকেসি বিভাগের অধিকর্তা কোমল গনোত্রার কথায়, ‘’১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষাকে আবশ্যিক করে তুলতে না পারার ফলেই অষ্টম শ্রেণির পর ছেলেমেয়েদের মধ্যে, বিশেষ করে, মেয়েদের মধ্যে স্কুল-ছুটের ঘটনা বেশি ঘটছে। জাতীয় স্তরে বার্ষিক গড় স্কুল-ছুটের হার প্রাথমিক স্তরে যেখানে মাত্র চার শতাংশ, সেখানে মাধ্যমিক স্তরে গিয়ে তা পৌঁছে যাচ্ছে প্রায় ১৮ শতাংশে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও উচ্চতর প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের স্কুল-ছুটের হার যেখানে যথাক্রমে ২.৩ শতাংশ এবং ৩.১ শতাংশ, সেখানে মাধ্যমিক স্তরে সেই সংখ্যাটা প্রায় ২০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলেছে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন কোনও আইনি রক্ষাকবচ না থাকার ফলেই এটা ঘটছে।’’
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে স্কুল-শিক্ষায় মেয়েদের পিছিয়ে পড়ার আরও একটা বড় কারণ, ওই দু’টি স্তরের স্কুলের সংখ্যাল্পতা। সারা দেশের নিরিখে মোট স্কুলের মধ্যে যেখানে মাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনোর জন্য রয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ স্কুল, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে মোট স্কুলের প্রায় ৮৩ শতাংশ প্রাথমিক ও ১৯ শতাংশ উচ্চতর প্রাথমিক। কিন্তু, এ রাজ্যেও মোট স্কুলের নিরিখে মাধ্যমিক স্তরের স্কুলের সংখ্যা অনেকটাই কম- মাত্র ১০.৫ শতাংশ।
এই তথ্য থেকে এটুকু স্পষ্ট, প্রাথমিক স্তরে বাড়ির কাছের স্কুলে পড়ার সুযোগ পেলেও, মাধ্যমিক স্তরে পড়তে গিয়ে ছেলেমেয়েদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে যেতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও সেই দূরত্বটা দশ বা পনেরো কিলোমিটার বা, তারও বেশি। এর ফলে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদেরই বেশি অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। কারণ, অভিভাবকরা ঝুঁকি নিয়ে নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়া মেয়েদের অতটা দূরে পাঠানোর পাচ্ছেন না। মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলিতে মেয়েদের ভর্তির হার কম হওয়ার আরও একটা কারণ, স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগারের অভাব আর স্কুলে শিক্ষিকা ও মহিলা শিক্ষাকর্মীদের সংখ্যাল্পতা।
তবে, এই সব সমস্যার মধ্যে কিছুটা আলোর রেখাও রয়েছে। গনোত্রা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘দেশজুড়েই কন্যা-শিশুদের শিক্ষায় সামিল করার ক্ষেত্রে বাড়তি সক্রিয়তা ও সদিচ্ছা চোখে পড়ছে। রাজ্যে যেমন পশ্চিমবঙ্গে ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে, তেমনই কেন্দ্রীয় ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ কর্মসূচিও দ্রুত রূপায়িত হচ্ছে। পথ অবশ্য অনেকটাই বাকি। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে আরও বেশি স্কুল গড়ে তোলার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে। সারা দেশে যেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সরকারি স্কুল মাত্র ৬৯ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে তা ৯৩ শতাংশ। শুধু দেখা দরকার, সরকারি সদিচ্ছা ও উদ্যোগ যেন রাজ্যের দূরবর্তী প্রান্তগুলির স্কুলেও পৌঁছয়।’’
আর তখনই আমাদের আশা ও সন্ধ্যার মতো আরও যে মেয়েরা রয়েছে, তাদের ছোট ছোট স্বপ্নগুলিকে সত্যি করার দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে। আশা ও সন্ধ্যার মতো মেয়েদের আরও এগিয়ে দেওয়া যাবে।
তথ্যসূত্র: ‘ডাইস’ (২০১৪-’১৫) সমীক্ষা।
তথ্য বিশ্লেষণ: ক্রাই- চাইল্ড রাইট্স অ্যান্ড ইউ।