রথ টানাতেও থাকে রাজনীতি করার সুযোগ। তবে মৌখিক ভাবে স্বীকার করেন না কোনও পক্ষ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মঙ্গলবার রথের দিন অন্যান্য বারের মতোই কলকাতার রাজপথে ইস্কনের রথযাত্রায় শামিল হবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বামপন্থীরা ছাড়া রথ টানবেন অন্যান্য অবামপন্থী দলের নেতা-কর্মীরাও। রথযাত্রা আগে ছিল উৎসব। কিন্তু ইদানীং রথযাত্রা রাজনৈতিক বিবৃতিও বটে।
রথ টানার সঙ্গে কি রাজনীতির কলা বেচার সুযোগও পাওয়া যায় না?
যায়। কিন্তু সেটা মুখে বলতে রাজি নয় কোনও দল। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায়, ‘‘ধর্মীয় উৎসব নিয়ে বিজেপি রাজনীতি করে না। দরকারও পড়ে না। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের যোগ বরাবরের। সেই যোগ এবং টান থেকেই মানুষের উৎসবে অংশ নেন দলের নেতারা। ভোট তো আর সব বছর থাকে না!’’
ঠিকই। ভোট সব বছর থাকে না। কিন্তু জনসংযোগ থাকে। এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের পরিসর থাকে। যেমন মঙ্গলবার নিজের এলাকা সিঙ্গুর এবং হরিপালে রথ টানবেন মন্ত্রী বেচারাম মান্না। তাঁর কথায়, ‘‘রথযাত্রা একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কথায় আছে, রথের রশিতে টান দিলে মৃত্যুর পরে স্বর্গে যাওয়া যায়। তাই ধর্মপ্রাণ মানুষ রথের দিনে সুযোগ পেলেই রথের রশিতে টান দেন। আমরাও তো সাধারণ মানুষ।’’পাশাপাশিই মন্ত্রী বলছেন, দুর্গাপুজো, কালীপুজো-সহ বিভিন্ন পুজোয় তাঁদের উদ্বোধক হিসাবে ডাকা হয়। জনপ্রতিনিধি হিসাবে জনতার ডাক তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না। তাই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাঁদের অংশগ্রহণকে কখনওই রাজনীতির সঙ্গে জুড়ে দেখা উচিত নয়।
তবে তৃণমূল নেতাদের বড় অংশই বিভিন্ন বারোয়ারি দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত। অনেক পুজো কমিটিই রথের দিন মণ্ডপের খুঁটিপুজো করে। কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম যেমন জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রথের দিনে তাঁর সবচেয়ে বড় কর্মসূচি চেতলা অগ্রণীর খুঁটিপুজো।
ঘটনাচক্রে, এ বছর পঞ্চায়েত ভোটের সময়কালেই এসেছে জগন্নাথের রথযাত্রা। ফলে রথ ও রাজনীতি আরও মিলেমিশে একাকার। রথ মানে ‘চলন্ত মন্দির’। প্রত্যাশিত ভাবেই সেই মন্দিরে জায়গা খুঁজতে যাননি বামপন্থীরা। অন্তত এখনও পর্যন্ত। কিন্তু অবামপন্থী রাজনীতিকেরা পঞ্চায়েত ভোটের এই আবহে রথের রাজনীতিতে বাড়তি রং চড়িয়েছেন।
রাজনীতির সঙ্গে রথ মেলাতে দেশে বিজেপির জুড়ি নেই। মুরলী মনোহর যোশী থেকে লালকৃষ্ণ আডবাণীরা বার বার রথারূঢ় হয়েছেন। ১৯৮৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৮০টির মতো আসন। ১৯৯১ সালে সেটা বেড়ে হয়ে যায় ১২০টি। প্রায় ২৭ শতাংশ আসন বৃদ্ধি। অনেকেই বলেন, এর পিছনে ছিল ১৯৯০ সালে হিন্দুত্বের ঝড়-তোলা আডবাণীর রথযাত্রা।
একটা সময় থেকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিরই অঙ্গ হয়ে উঠেছিল রথযাত্রা। কংগ্রেস সে পথে কখনও না গেলেও উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টিকে রথযাত্রার আয়োজন করতে দেখা গিয়েছে। বিজেপি রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারের ‘হাতিয়ার’ করেছে রথকে। বাংলায় গত বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঁচটি ‘পরিবর্তন রথযাত্রা’ বার করেছিল গেরুয়া শিবির। সদ্যসমাপ্ত কর্নাটক নির্বাচনেও রথে চেপেছিল বিজেপি। দুই রাজ্যেই অবশ্য রথ জয়ের পথ দেখাতে পারেনি।
তৃণমূলের নেতাদের কাউকে কখনও রথে চড়তে দেখা যায়নি। যদিও ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে রথে চেপেছিলেন তৃণমূলের প্রার্থী দশরথ তিরকে। দুই ঘোড়ায় টানা গাড়িকে ‘বিজয়রথ’ নাম দিয়েছিলেন তিনি। তৃণমূল নেত্রী মমতাকেও কখনও রথে চড়তে হয়নি। যদিও তিনি রথযাত্রার দিন ইস্কনের রথ উৎসবে শামিল হয়েছেন। তা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন বিরোধীরা। ইস্কনের রথ টানতে মমতা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন দলের সাংসদ নুসরত জাহানকে। নুসরতের পাশে ছিলেন অভিনেতা সোহম চক্রবর্তীও। তবে রথযাত্রায় মুসলিম ধর্মাবলম্বী নুসরতের উপস্থিতি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কর্ণপাত করেননি মমতা। করার কথাও নয়। কারণ, নুসরতকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে তিনি ধর্মের থেকে উৎসবকে আলাদা করে দেখার বিবৃতিটি দিতে চেয়েছিলেন। মঙ্গলবারও ইস্কনের রথযাত্রায় অংশ নিয়ে মমতা কিছু বলেন কি না, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, পুরীধামে জগন্নাথের রথের প্রতিও বাংলার রাজনীতিকদের একাংশের টান রয়েছে। বাংলার অবামপন্থী নেতাদের অনেকে সুযোগ পেলেই টুক করে পুরী চলে যান। মুখ্যমন্ত্রী মমতাও যান। যেতেন প্রয়াত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও। বস্তুত, বাঙালির টান বুঝেই দিঘায় পুরীর অনুকরণে জগন্নাথ মন্দির বানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। রাজ্যের তরফে পুরীতে অতিথিশালা তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে। সদ্য ওড়িশায় গিয়ে সে বাবদ জমি দেখে এসেছেন মমতা। তবে মমতার সঙ্গে পুরীর সম্পর্ক অনেক গভীর এবং দীর্ঘকালীন। তা নিয়ে কেউ রাজনীতির অভিযোগ তোলেন না। পুরীর দ্বৈতাপতিরা কালীঘাটে এসে মুখ্যমন্ত্রীর পারিবারিক পুজোতেও অংশ নিয়েছেন।
বাংলায় রথ-রাজনীতি বড় আকার নেয় ২০১৯ সালে। লোকসভা নির্বাচনের আবহে মুকুল রায় থেকে দিলীপ ঘোষ— সকলেই রথের রশিতে টান দিয়েছিলেন সে বছর। মমতা সে বার কলকাতায় ইস্কনের রথের সূচনা করে চলে গিয়েছিলেন হুগলির মাহেশে। এ বছরও বাংলার বিভিন্ন এলাকার রথযাত্রা নিয়ে কর্মসূচি রয়েছে তৃণমূলের। কসবা, যাদবপুর থেকে কোচবিহার, মালদহে রথে মিশবে রাজনীতি। হুগলির মাহেশে যাবেন মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। বাগবাজারের রথে থাকবেন দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং ইন্দ্রনীল সেন।
প্রস্তুতি নিয়েছে বিজেপিও। দলের নির্দেশ— সব নেতা, সাংসদ, বিধায়ককেই মঙ্গলবার রথযাত্রার শুভেচ্ছা জানাতে হবে সমাজমাধ্যমে। নিজের নিজের এলাকার রথযাত্রায় অংশও নিতে হবে। গত বছর হাওড়ার সাঁকরাইলের নবঘরা এলাকায় রথের দড়ি টেনেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। খঞ্জনি বাজিয়ে ভক্তদের সঙ্গে নাচের তালে পা-ও মিলিয়েছিলেন তিনি। এ বার তাঁর তমলুক এবং নন্দীগ্রামে রথ টানার কথা। যেতে পারেন অন্যত্রও। দিলীপ জানিয়েছেন, কলকাতার কাশীপুরে রথযাত্রায় থাকবেন। রথের টানে সোমবার রাতেই নিজের লোকসভা কেন্দ্র বালুরঘাটে চলে গিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত। সেখানেও ধুমধাম করে রথযাত্রা হয়। তাতে অংশ নেবেন তিনি।
রথ টানার সঙ্গে রাজনীতির কলা বেচার সুযোগ আর কে ছাড়ে!