Rabindranath Tagore

সে কালের চিনে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন শান্তির কথা

২২শে শ্রাবণ প্লাবনের জোয়ারে চিন বক্তৃতাগুলি কি পড়ব আমরা? প্রশ্ন তুললেন আশিস পাঠকদেশটার নাম চিন। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ চিনে গিয়েছিলেন। ভ্রমণ করেছিলেন ৪৯ দিন। বক্তৃতা করেছিলেন নানা জায়গায়। তখন এক উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে দেশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৭ ১০:০০
Share:

অলঙ্করণ: জু পিয়ং

পঁচানব্বই বছর আগে নিজের দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আসার খবর পেয়ে একটি পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখছে, ‘পশ্চিম, এমনকী সমস্ত পৃথিবী আজ রক্ত-লাল মেঘে এবং ঈর্ষার ঘূর্ণি-ঝড়ে আবর্তিত। প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল পরস্পরের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে, পরুষকণ্ঠে প্রতিহিংসার গান গাইছে, লোহা ও বন্দুকের সুরের সঙ্গে মত্ত হয়ে নাচছে। শুধু রবীন্দ্রনাথ এক বিরাট পুরুষের মতো হিমালয় ও আল্পসের চূড়ায়, ভোরের শান্ত উজ্জ্বল আলোয় দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে মানুষের কাছে শান্তি ও প্রেমের বাণী উচ্চারণ করছেন।’

Advertisement

দেশটার নাম চিন। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ চিনে গিয়েছিলেন। ভ্রমণ করেছিলেন ৪৯ দিন। বক্তৃতা করেছিলেন নানা জায়গায়। তখন এক উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে চিন। আর পরিবর্তনের সেই ঝোড়ো হাওয়ায় কী বলবেন কবি, সেই দ্বিধা ছিল তাঁর প্রথম বক্তৃতাতেই: ‘আপনাদের ধর্ম এবং প্রথা সম্পর্কে এত বিরোধী মতামতের কথা আমি পড়েছি যে ভাবছিলাম এঁরা আমাকে কিসের জন্য আমন্ত্রণ করেছেন, এঁদের কল্যাণের জন্য কোন্ বাণী বহন করে নিয়ে যাওয়া আমার কর্তব্য।’

আরও পড়ুন: ‘রবিকা’ চলে গিয়েছিলেন অবনের জন্মদিনেই

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ মূলত শুনিয়েছিলেন শান্তির কথা, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা। আর সেই কথাগুলো আজকের এই দুঃসময়েও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বিনা বিতর্কে তাঁর কথাগুলো চিনে গৃহীত হয়নি। ক্রমেই জমে উঠছিল সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়া, প্রতিরোধও। এমনকী, পেইচিং বক্তৃতামালার দ্বিতীয় দিনে ছাত্রেরা হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করল রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। শিশিরকুমার দাশের করা তার অনুবাদ থেকে বোঝা যায় কতটা তীব্র ছিল প্রতিক্রিয়া: ‘আমাদের কৃষি চাষীর ক্ষুধা নিবারণে অক্ষম, আমাদের শিল্প কুটির শিল্প মাত্র, আমাদের নৌকা, আমাদের যান বাহন দিনে কয়েক মাইলের বেশি যেতে অসমর্থ,... আমাদের পথঘাট আমাদের শৌচাগার, আমাদের রন্ধনশালা পৃথিবীর চোখে হাস্যকর। অথচ রবীন্দ্রনাথ বস্তুসভ্যতার আধিক্যের জন্য আমাদের তিরস্কার করছেন। তাই আমরা তাঁর প্রতিবাদ করতে বাধ্য।... রবীন্দ্রনাথ বলছেন ব্রহ্মের কথা আত্মার মুক্তির কথা। এই অকর্মণ্য তত্ত্বের বিরুদ্ধে আমাদের আপত্তি।’

আরও পড়ুন: যদি রবিঠাকুর থাকেন!

আর রবীন্দ্রনাথ সাংহাই পৌঁছবার দু’দিন পরে চিনা কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথম যুগের নায়ক মাও তুন একটি পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের প্রত্যাশা’ প্রবন্ধে লিখলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে যে উপহার আমরা প্রত্যাশা করি তা আধ্যাত্মিক জীবনসাধনা নয়, সেই শূন্যগর্ভ গীতাঞ্জলি নয়, বরং সেই বেদনা ও উৎসাহ জাগানো ‘একলা চলো রে’।’

রবীন্দ্রনাথের চিনে দেওয়া বক্তৃতাগুলি পরে সংকলিত হয়েছে Talks in China-য়। ১৯২৪-এই তার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সে বইয়ে ছিল সে বছর ১২ এপ্রিল থেকে ৩০ মে চিনে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের কিছু বক্তৃতা। সেগুলি বক্তৃতা হিসেবেই ছাপা হয়েছিল, স্থাননির্দেশ-সহ। তখনও তাদের ছেঁটেকেটে মিলিয়েমিশিয়ে প্রবন্ধ করা হয়নি। সেটা হয়েছিল ১৯২৫-এর সংস্করণে। তার ভূমিকায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ জানাচ্ছেন, বক্তৃতাগুলি এই প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হচ্ছে এবং ‘দ্য টেক্সট ইজ বেসড মেনলি অন নিউজপেপার রিপোর্টস অ্যান্ড হ্যাজ নট বিন রিভাইজড বাই দ্য পোয়েট’।

আরও পড়ুন: স্মরণের ফ্রেমে ২২শে শ্রাবণ

নিশিদিনমান কর্ম-অনুরত যে প্রবীণ প্রাচীন চিনের বইয়ে-পড়া ছবি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিনে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে বাস্তবের তফাত ঘটে গিয়েছিল অনেকটাই। কিন্তু সেই রক্ত-লাল মেঘ যেন আজকের অসহিষ্ণু সময়েরও প্রতীক।

অশ্রুগলিত গীতে বাইশে শ্রাবণ পালনের জোয়ারে তাঁর চিন বক্তৃতাগুলি নতুন করে এই সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় পড়ব কি আমরা?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement