প্লাস্টিকের কৌটৌ, বোতল ঝুলিয়ে এভাবেই চলছে হুকিং। নিজস্ব চিত্র।
কোথাও বাড়ি বাড়ি অবৈধ সংযোগ, কোথাও রাতারাতি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে আস্ত ট্রান্সফর্মার। বিদ্যুৎ চুরির বহরে জেলা তো বটেই রাজ্যের মধ্যেই ‘নাম’ কেড়েছে কালনা মহকুমার মন্তেশ্বর ব্লক।
বিদ্যুৎ দফতরের হিসেব অনুযায়ী এই ব্লকে লাভের বদলে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৮৪ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ চুরি ঠেকাতে এলাকা জুড়েই বড়সড় অভিযানে নামছে বিদ্যুৎ বন্টন নিগম।
প্রশাসনের সূত্রে খবর, গত ১৩ জুলাই রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী দফতরের আধিকারিক ও জেলাশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন। সেই বৈঠকে দাবি করা হয়, রাজ্যে ব্যাপক বিদ্যুৎ চুরির জন্যই অনেক সময় পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটছে। কোন কোন এলাকায় বেশি বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে, সে প্রসঙ্গও উঠে আসে বৈঠকে। সেই সূত্রেই আসে মন্তেশ্বর ব্লকের নাম। দফতরের তরফে হিসেব দেওয়া হয়, এই ব্লকে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৮৪ শতাংশ, গোটা রাজ্যের নিরিখে যা দ্বিতীয়। এই তথ্য শুনেই টনক নড়ে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের।
কী ভাবে ব্লকের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে? বিদ্যুৎ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এই এলাকায় বাড়ি বাড়ি সংযোগ ও মাঠে চাষের জল তোলার জন্য যে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়, তার বেশির ভাগটাই চুরির। দফতরের এক কর্তা জানান, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, বাড়িতে মিটার থাকলেও ছাদ থেকে হুকিং করেই বিদ্যুতের দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বাড়ির মিটারে কারচুপি তো আছেই। বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা জানান, বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, মিটার বাড়ির অনেক ভিতরে বসানো হচ্ছে। তাতে অনেক সময় অভিযানের খবর মিললেই বাড়ির লোকজন মিটার ঠিক করে দেওয়ার সময় পেয়ে যাচ্ছেন। তবে এই ব্লকে সবথেকে বেশি বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে খেতের কাজে। এই এলাকায় বছরভরই ধান চাষ হয়। জল তোলার জন্য সাবমার্সিবল পাম্প চালাতেও চুরি করা বিদ্যুৎই ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা। এলাকা ঘুরে দেখা গেল, বহু জায়গায় স্থানীয় বাসিন্দারা বানিয়ে ফেলেছেন আস্ত ট্রান্সফর্মার।
দফতরের দাবি, অভিযান চালিয়েও অনেক সময় লাভ হয় না। যেমন, জুন মাসে এই ব্লকে বিদ্যুৎ চুরি ও বিল না দেওয়ায় ২৯টি বাড়িতে সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় ফের ১৯টি বাড়িতে অবৈধ সংযোগ নেওয়া হয় বলে জানতে পারেন বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীরা। শুধু তাই নয়, এলাকায় বড়সড় অভিযান চালাতে গেলে দুষ্কৃতী তাণ্ডবেরও সম্ভাবনা রয়েছে বলে কর্তাদের দাবি।
বিদ্যুৎ দফতরের তথ্য অনুসারে, মন্তেশ্বর ব্লকে কুসুমগ্রাম সাব স্টেশন থেকে ২৫.২ ও নাদনঘাট সাব স্টেশন থেকে ১১.৩ মেগা ভোল্ট ইউনিট বিদ্যুৎ যায়। বছরে ওই ব্লকে ৯৫ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। কিন্তু মাত্র ১৫ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুতেরই টাকা মেলে মেলে। বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তা জানান, টাকার অঙ্কে এই ব্লকে লোকসানের পরিমাণটা বছরে ৪৮ কোটি টাকা। শুধু মন্তেশ্বর ব্লকই নয়, গোটা কালনা মহকুমাতেই বিদ্যুৎ দফতরের লোকসান হচ্ছে বলে মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে জানানো হয়। যেমন, কালনায় ৩৫.১৬, বৈদ্যপুরে ৪৭.২১, ধাত্রীগ্রামে ৬৩.৪৮, সমুদ্রগড়ে ৫৯.১৬ ও পূর্বস্থলীতে লোকসানের পরিমাণ ৬২.৭৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে গোটা কালনা ডিভিশনে বছরে ৬৭.৬৩ শতাংশ লোকসান হয়।
মন্তেশ্বর ব্লকের লোকসান নিয়ে চিন্তায় দফতরের কর্তারা। কালনার ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার চঞ্চল বিশ্বাস বলেন, ‘‘বহু বছর ধরে ওখানে ব্যাপক হারে বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। চুরি ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য দরকার। এর জন্য বিডিও, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বিধায়ক, পঞ্চায়েত প্রধানদের নিয়ে দ্রুত বৈঠক হবে।’’ এ ছাড়া সচেতনতা প্রচার ও অভিযানও চালানো হবে বলে জানিয়েছে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন নিগম।