কতটা ছড়িয়ে রয়েছে নিয়োগ দুর্নীতির এই জাল, উঠছে প্রশ্ন। প্রতীকী ছবি।
গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও।
নিয়োগ দুর্নীতির রকমসকম দেখে এই গানটির কথাই মনে পড়ে। যে দুর্নীতির তদন্তে প্রথম দিকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তল্লাশির সময়ে সামনে এসেছিল রাশীকৃত টাকা, যেখানে একে একে হাতকড়া পড়েছে শিক্ষা দফতরের তাবড় কর্তাব্যক্তির হাতে। সেখানেই কিন্তু জাল শেষ হয়নি। বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে আরও নানা দিকে। শহর ছাড়িয়ে জেলায় তৃণমূলের ছোট-মাঝারি নেতা, তাঁদের সঙ্গী বা পরিচিতদের নাম সামনে আসতে শুরু করেছে তদন্ত এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে। কোথাও আবার জুড়ছে তৃণমূলের বিধায়কদের কারও কারও নামও। শুক্রবার থেকে যেমন টানা তল্লাশি চলছে মুর্শিদাবাদের বড়ঞার বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহার বাড়িতে। সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। অন্য দিকে, চন্দন মণ্ডল, তাপস মণ্ডল, কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, অয়ন শীলের পরে তদন্তকারীদের নজর রয়েছে গোপাল দলপতিদের উপরেও।
এই আবহে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন— কতটা ছড়িয়ে রয়েছে নিয়োগ দুর্নীতির এই জাল? এতে কি আরও প্রভাবশালী জড়িত? বাকি জালের পুরোটাই কি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা রাজ্যের জেলায় জেলায়? কী ভাবে এর থই খুঁজে পাওয়া যাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ওয়াকিবহাল মহলের কারও কারও দাবি, মধ্যপ্রদেশের ব্যপম কেলেঙ্কারি বাদ দিলে এত বিস্তৃত কেলেঙ্কারির কথা খুব বেশি জানা যায়নি।
সিবিআই এবং ইডি-র তদন্তকারীদের প্রাথমিক দাবি, নিয়োগ-দুর্নীতির টাকা হুগলির নির্মাণ ব্যবসায়ী অয়ন শীলের মাধ্যমে রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছত। একটি মহলের দাবি, পার্থকে যদি এই দুর্নীতি-কাণ্ডের একটি ‘মাথা’ ধরা হয়, তবে অয়ন তাঁর অন্যতম প্রধান এজেন্ট। পার্থ ও অয়নের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটি করতেন কুন্তল ঘোষ (যিনি শান্তনুর ঘনিষ্ঠ)-সহ বেশ কয়েক জন এজেন্ট। তদন্তকারীদের দাবি, এই তথ্য মিলেছে হুগলির তৃণমূল নেতা, ধৃত শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। শান্তনু ও কুন্তল দু’জনেই এই মুহূর্তে তৃণমূল থেকে বহিষ্কৃত। হাই কোর্টে ইডির দাবি, অন্তত দু’শো চাকরিপ্রার্থীর থেকে কোটি-কোটি টাকা তুলেছেন কুন্তল। আর তা হয়েছে তাঁর ‘নিজস্ব এজেন্টদের’ মাধ্যমে। এঁদের অন্যতম পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর-২ ব্লকের খিরিশবাড়ি গ্রামের, বর্তমানে দমদমের বাসিন্দা গোপাল দলপতি। রয়েছেন আরও অন্তত ২২ জন এজেন্ট। পাশাপাশি, তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত নদিয়া জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ চঞ্চল দেবনাথ ও কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল অরূপ মুখোপাধ্যায় ওরফে টিঙ্কুর পার্থকে ভেট পাঠানোর অভিযোগ করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। অভিযুক্তেরা অবশ্য শুভেন্দুর কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। উল্টো দিকে, ২০১২ সালে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে তদন্তের মামলা হয়েছিল হাই কোর্টে। যে মামলাকে ‘পুরনো অভিযোগ’ বলে খারিজ করে দিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
তদন্তকারীদের দাবি, এই সব অভিযোগ যদি জালের একটি পিঠ হয়, তবে অন্য পিঠে আছে পুরো বিষয়টির সঙ্গে নাইসা-র আধিকারিক নীলাদ্রি দাসের যুক্ত থাকার অভিযোগ। সিবিআইয়ের দাবি, নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্ব বর্তেছিল এই নাইসা-র উপরেই। সেই সুযোগে নীলাদ্রিও দালাল-বাহিনী তৈরি করেছিলেন বলে দাবি। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তাঁর ন’জন দালাল সক্রিয় ছিলেন বলেও অভিযোগ। ওই ন’জনের সঙ্গে আরও অন্তত ৫০ জন দালালের যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, পার্থের সঙ্গে এই দুর্নীতির আর একটি ‘মাথা’ হলেন রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য। মানিক গ্রেফতার হওয়ার পরেই সামনে আসে পাঁশকুড়ার তাপস মণ্ডলের নাম। যিনি পরে গ্রেফতার হন। এই তাপসের সংস্থায় আবার কাজ করতেন নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে অন্যতম ধৃত, কাঁথির তাপস মিশ্র। এঁদের সবাই এজেন্টেরই ভূমিকা নিতেন বলে প্রাথমিক ভাবে দাবি তদন্তকারী সংস্থার।
বাগদার চন্দন মণ্ডল-সহ আরও ছ’জন এজেন্টকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। সিবিআইয়ের দাবি, চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রভাবশালীদের কাছে পৌঁছে দিতেন তাঁরা। যদিও, বাগদার এক যুবকের আবার বক্তব্য, “আমি স্কুলে চাকরির জন্য চন্দনকে সরাসরি টাকা দিইনি। তাঁর এক দালালকে দিয়েছিলাম!” এই অভিযোগ সত্যি হলে বুঝতে হবে, দালাল চক্রের শিকড় আরও গভীরে।
তদন্তকারীরা প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন, এই ভাবে, দালালের দালাল, তার দালাল, তস্য দালাল হয়ে টাকা উঠত চাকরিপ্রার্থীদের থেকে এবং সেই টাকা যেত প্রভাবশালীদের কাছে।
প্রশ্ন উঠেছে, পার্থ, মানিক ছাড়া আরও কি কোনও প্রভাবশালী আছেন, যাঁদের কাছে পৌঁছত এই অর্থ? তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে এই নিয়ে নানা ইঙ্গিত দিয়েছেন তদন্তকারীরা। তেমনই কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন একটি ছবির গান— গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও। দালালচক্রের মতো হয়তো প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রেও যেতে হবে আরও গভীরে। যাঁদের সম্পর্কে ইডি আদালতে জানিয়েছে, শান্তনুর ডায়েরিতে এমন অনেক নাম আছে, যেগুলি এখনই প্রকাশ্যে বলা সম্ভব না।
(চলবে)