‘প্রভাবশালী’ যোগের সূত্রেই একের পর এক পুরসভায় জাল বিস্তার করেছিলেন অয়ন। ফাইল চিত্র।
বাম জমানায় চিরকুটে বহু চাকরি (বেআইনি ভাবে) হয়েছে বলে প্রায়ই অভিযোগ তোলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। বারবার সে কথা বলে তাঁর দল। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতি-কাণ্ডে অয়ন শীল গ্রেফতার হওয়ার পরে বহু পুরসভায় কান পাতলে এখন শোনা যাচ্ছে সেই চিরকুটের কথাই!
অভিযোগ, প্রভাবশালী যোগের সূত্রেই একের পর এক পুরসভায় জাল বিস্তার করেছিলেন বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অয়ন। সেই প্রভাব নাকি এতটাই ছিল যে, পুরসভাগুলির অন্দরে অনেকে অনেক কিছু জেনেও কার্যত চুপ থাকতে বাধ্য হতেন। সূত্রের খবর, কেউ আপত্তি তুললে, অনেক সময় এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ফোন ধরিয়ে দেওয়া হত সংশ্লিষ্ট পুরসভার শীর্ষকর্তাকে। কখনও আবার বার্তা আসত চিরকুট মারফত। এই ‘দাপট’ ছিল বলেই বহু পুরসভায় অয়নের সংস্থা পরপর দু’বার নিয়োগের নামে দুর্নীতি চালাতে পেরেছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে দাবি।
যেমন, ২০১৭ সালে উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন পুরসভায় কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু সূত্রের দাবি, তখন প্রায় কোনও পুরসভার নিজেদের নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষার পরিকাঠামো ছিল না। বিষয়টি তখন ডিএলবি-র (ডিরেক্টরেট অব লোকাল-বডি) কাছে জানানো হয়। সেই সূত্রে হুগলির সংস্থা এবিএস ইনফোজ়োনের নাম পৌঁছে যায় দমদম, উত্তর দমদম, দক্ষিণ দমদম, বরাহনগর, কামারহাটি, পানিহাটি, হালিশহর-সহ বিভিন্ন পুর-কর্তৃপক্ষের কাছে। এক পুরকর্তা বলেন, “ডিএলবি থেকে সুপারিশ করা হয়েছিল। তাই আমরাও আপত্তি করিনি।”
অখ্যাত এক সংস্থাকে (যা আদতে অয়নের) এতগুলি পুরসভায় দায়িত্ব দেওয়া হল কেন, সেই প্রশ্ন তখনই উঠেছিল। কিন্তু তা ধোপে টেকেনি। সূত্রের খবর, ডিএলবি-র তৎকালীন কয়েক জন আধিকারিক ও পুর দফতরের কর্মী সংগঠনের এক নেতার (বীরভূমের বাসিন্দা) কাছ থেকে সুপারিশ আসায় ওই সমস্ত পুরসভায় অয়নের প্রবেশের পথ সুগম হয়। পুরসভাগুলির অন্দরের খবর, অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ ওই নেতা বিভিন্ন পুরসভার কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতেন অয়নের সংস্থাকে দিয়ে নিয়োগের পরীক্ষা করানোর জন্য। তাতে অরাজি হলে, ওই নেতা ফোনে
ধরিয়ে দিতেন প্রভাবশালী এক মন্ত্রীকে। তাঁর কাছ থেকে চলে আসত নির্দেশ। আবার কখনও-সখনও সেই মন্ত্রীর থেকে চিরকুটেও বার্তা আসত পুরসভায়। এক পুর আধিকারিক বলছেন, “যাঁর মাথায় এত উপর মহলের হাত, তাঁকে কে কী বলবেন!”
২০১৭-তে উত্তর ২৪ পরগনার একের পর এক পুরসভায় নিয়োগের পরীক্ষার বরাত পায় অয়নের সংস্থা। জানা যাচ্ছে, ২০১৭-তে প্রথম পরীক্ষা হলেও নিয়োগ হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেই নিয়োগের কয়েক মাসের মধ্যেই ফের ওই সমস্ত পুরসভায় পরীক্ষা নেওয়ার বরাত পেয়েছিলেন অয়ন।
টেন্ডারের মাধ্যমে অয়নের সংস্থা নিয়োগের পরীক্ষার বরাত পাওয়ার কথা উঠে এলেও, বেশির ভাগ পুরসভায় ‘ঠিকঠাক ভাবে নিয়ম মেনে’ কোনও টেন্ডার হয়নি বলেই জানা যাচ্ছে এখন। সূত্রের খবর, অয়ন নিজের সংস্থার পাশাপাশি বেনামে আরও তিন-চারটি দরপত্র জমা করতেন। কামারহাটি পুরসভা সূত্রের খবর, ২০১৬ সালে অয়ন যে দরপত্র জমা করেছিলেন, তা নিয়ে বোর্ড মিটিংয়ে আলোচনা করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এমনকি তা অয়নকে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছিল। কার্যত একচেটিয়া ভাবে বরাত পাওয়ার পরে চাকরিতে কাদের নেওয়া হবে, সে বিষয়ে অয়নের সঙ্গে পুরসভার রফা হত বলেও জানা যাচ্ছে। সেখানেই ঠিক হত, প্রতিটি পুরসভায় কাউন্সিলরদের ক’টি করে কোটা (কত জনকে তিনি চাকরি দিতে পারবেন) থাকবে, আর অয়নের সংস্থার ঠিক করা কত জন চাকরি পাবেন। সূত্রের খবর, কাউন্সিলর পিছু ১-২টি করে কোটা রাখা হত। বাকি পুরোটাই অয়ন ঠিক করতেন। এ ভাবেই চলত মোটা টাকার খেলা।
এই দুর্নীতিতে কাজ করতেন কয়েক জন এজেন্ট। সূত্রের দাবি, কোনও পুরসভার চেয়ারম্যান-পারিষদ, কোথাও পুর কর্মীরা সেই ভূমিকা পালন করতেন। অভিযোগ, পুর কর্মী সংগঠনের সেই নেতার মাধ্যমে এজেন্টরা যোগাযোগ করতেন অয়নের সংস্থার সঙ্গে। নিজের মতো করে এক-এক পুরসভার জন্য নিয়োগের এক-এক রকম নিয়ম ঠিক করতেন অয়ন। সেই মতো বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। কয়েক জন পুরকর্তার কথা রাখতে তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দেরও পার্শ্ববর্তী পুরসভায় নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন অয়ন।
পুর নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে বুধবার পানিহাটি ও দক্ষিণ দমদম পুরসভার সামনে বিক্ষোভ দেখায় বামেরা। সিপিএম নেতা পলাশ দাশ বলেন, “স্কুল থেকে পুরসভা, সর্বত্র অর্থের বিনিময়ে চাকরি বিক্রি হয়েছে। সব ক্ষেত্রকে ইডির তদন্তের আওতায় আনা হোক।” উত্তর দমদমে বাম ছাত্র যুব সংগঠনের তরফে পুরসভায় নিয়োগ কাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল করা হয়।
সহ-প্রতিবেদন: কাজল গুপ্ত