অয়ন শীল। ফাইল চিত্র।
কেউ একাই একশো কোটি তো কেউ সাড়ে তিনশো কোটি! নিয়োগ দুর্নীতিতে এ ভাবেই কালো টাকায় ভাঁড়ার ভরার প্রতিযোগিতা চলছিল বলে ইডি-র অভিযোগ। তাদের দাবি, বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ একাই যদি শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির বিষচক্র থেকে ১০০ কোটি টাকা তুলে থাকেন, শিক্ষা ও পুরসভায় দুর্নীতির বৃহত্তর চক্র থেকে একাই ৩৫০ কোটি টাকার কুবের-ভান্ডার গড়ে তুলেছেন প্রোমোটার অয়ন শীল। টাকা বানানোর ক্ষেত্রে এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি যে অয়নকে কার্যত ‘মানি মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করে এসেছেন, সেটাও তদন্তে পরিষ্কার।
আগে ইডি জানিয়েছিল, শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে তারা তদন্ত করছে, পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে তাদের এখন কোনও মাথাব্যথা নেই। তবে তদন্তকারীদের দাবি, তদন্তে নেমে পুর-দুর্নীতি সংক্রান্ত বহু নথিও তাঁদের হাতে পৌঁছেছে। আর সেই সব নথি ঘেঁটে তাঁদের দাবি, শিক্ষা ও পুরসভা— দুই নিয়োগ দুর্নীতি মিলিয়ে অয়নের উপার্জন ৩৫০ কোটি টাকা।
ইডি-র অভিযোগ, অয়ন ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শিক্ষা ও পুরসভায় নিয়োগ দুর্নীতি চালিয়ে গিয়েছিলেন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্তত আড়াই হাজার অযোগ্য প্রার্থীর কাছ থেকে তুলেছিলেন কোটি কোটি টাকা। তদন্তকারীদের দাবি, অয়ন যে সরকারি নির্মাণকাজের টেন্ডার বা দরপত্র সংক্রান্ত দুর্নীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন, তার তথ্যপ্রমাণ তাঁদের হাতে পৌঁছেছে। পরবর্তী পর্যায়ে আদালত নির্দেশ দিলে পুরসভায় নিয়োগ এবং অন্যান্য দুর্নীতির সঙ্গে অয়নের যোগাযোগ নিয়ে তদন্ত করা হবে।
তৃণমূলের বহিষ্কৃত যুব নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুন্তলকে (দু’জনেই নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় জেলবন্দি) গ্রেফতারের পরে তাঁদের ঘনিষ্ঠ প্রোমোটার তথা ঘুরপথে পুরসভায় নিয়োগের পান্ডা অয়নের নাম উঠে আসে। সল্টলেকে অয়নের ফ্ল্যাট এবং হুগলির বাড়িতে শিক্ষা ও পুরসভায় নিয়োগ দুর্নীতির বহু নথি পাওয়া গিয়েছে। সেই সব নথি পেশ করা হয়েছে আদালতে। অয়ন কী ভাবে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে শিক্ষা ও পুরসভায় নিয়োগ দুর্নীতি চালিয়েছেন, সেই নথি থেকেই তা স্পষ্ট বলে ইডি-র দাবি। তারা জানায়, কেস ডায়েরির মাধ্যমেও অয়নের কীর্তিকলাপ আদালতে তুলে ধরা হয়েছে।
তদন্তকারীদের দাবি, টাকা তোলার পরিমাণে এবং দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার কৌশলগত বিচারে শান্তনু ও কুন্তলের থেকে অয়ন বেশ কয়েক কদম এগিয়ে। তাঁর প্রভাবশালী-যোগ এবং দুর্নীতির ব্যাপ্তি ওই দু’জনের থেকে অনেকটাই বেশি। ইডি-র দাবি অনুযায়ী, শুধু নিয়োগ নয়, নগরোন্নয়ন দফতরের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অমৃত’ জল প্রকল্পের পরিকাঠামোর কাজের একটা বৃহৎ অংশের বরাত পেয়েছিল অয়নের সংস্থা। অয়নের সঙ্গে নগরোন্নয়ন দফতরের এক অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম অধিকর্তার যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে এবং অয়নের ছেলে অভিষেকের সঙ্গে তাঁর বান্ধবীর একাধিক সম্পত্তির হদিস মিলেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। অভিযোগ, ওই বান্ধবীর বাবা একদা নগরোন্নয়ন দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা ছিলেন।
তদন্তকারীদের দাবি, পুলিশ, প্রশাসনের এক শ্রেণির কর্তা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির সঙ্গে অয়নের যোগসাজশ রয়েছে বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীরা অয়নকে কার্যত টাকা তৈরির যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। ইডি-র দাবি, হেফাজতে থাকাকালীন পুরসভা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রভাবশালী-যোগের কথা স্বীকার করেছেন অয়ন। তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের একটি তালিকা পেশ করা হয়েছে আদালতে।
তদন্তকারীদের দাবি, এখনও পর্যন্ত অয়নের নামে-বেনামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নগদ টাকা-সহ ২৫ কোটি টাকার সম্পত্তির হদিস পাওয়া গিয়েছে। এক ইডি-কর্তা বলেন, “২০১৭-র পরে নিয়োগ দুর্নীতিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন অয়ন। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে বিভিন্ন অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সেগুলি তাঁর দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপে কোনও বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। অয়নের মাথায় এক জন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তির হাত ছিল। সেই কারণে অয়নের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই ধোপে টেকেনি। পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্তারা কার্যত হাত গুটিয়ে নীরব দর্শক হয়ে ছিলেন।’’ ওই ইডি-কর্তার দাবি, অয়নের দুর্নীতি চক্র থেকে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ লাভবান হয়েছে বলেও তদন্তে জানা গিয়েছে।