হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রবীন্দ্রনাথ ওরফে কানু। নিজস্ব চিত্র
সাঁতারটা ছোটবেলা থেকেই রপ্ত ছিল। সেটা যে মাঝসমুদ্রে তাঁকে বেঁচে থাকার রসদ জোগাবে, কেখনও ভাবেননি। বঙ্গোপসাগরে ট্রলার দুর্ঘটনার পর চার দিন ধরে মনের জোরে উত্তাল সমুদ্রে ভেসে থেকে দেশে ফিরেছেন নামখানার নারায়ণপুরের রবীন্দ্রনাথ দাস ওরফে কানু। কিন্তু মনে শান্তি নেই। কাকদ্বীপ সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে শুয়ে বছর সাঁইত্রিশের ওই যুবকের একটাই আক্ষেপ, ‘‘চোখের সামনে ১৩ জনকে তলিয়ে যেতে দেখলাম। কাউকে বাঁচাতে পারলাম না।’’
এই মরসুমে ৩ জুলাই-ই প্রথম সমুদ্রে ‘এফ বি নয়ন-১’ নামে ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে যান কানু। তিনিই ছিলেন চালক। সঙ্গে ছিলেন আরও ১৫ জন। যাঁরা শুধু একই পেশার লোক নন, কানুর পরিজনও। সমুদ্রে দুর্যোগ শুরু হয় ৬ জুলাই ভোর থেকে। আর সে দিনই তাঁদের ট্রলার দুর্ঘটনায় পড়ে।
শনিবার বাংলাদেশ থেকে ফিরে কাকদ্বীপ হাসপাতালে ভর্তি হন কানু। রবিবার সেই হাসপাতালেই সেই দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি শিউরে উঠছিলেন। কানু জানান, দুর্যোগের সময়ে সব মিলিয়ে সমুদ্রে প্রায় ১৫০টি ট্রলার ছিল। দুর্যোগ শুরু হতেই সব ট্রলার উপকূলের দিকে রওনা দেয়। সে সময় প্রায় তিন তলা সমান ঢেউ উঠছিল। বিপদের গন্ধ পেয়ে কানু সকলকে ‘লাইফ জ্যাকেট’ পরতে বলেন। তবে নিজে পরেননি হাল ধরতে অসুবিধে হয় বলে। ট্রলার এগোতে থাকে। তার পরেই দুর্ঘটনা।
কানু বলেন, ‘‘ট্রলার ঢেউয়ের তোড়ে সামনের দিকে এতটাই কাত হচ্ছিল যে হাল জল থেকে উঠে যাচ্ছিল। ট্রলার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। আচমকা বাঁ দিকে উল্টে যায়। দু’জন ভিতরে ছিলেন। বেরোতে পারেননি। আমরা ১৪ জন বেরিয়ে দেখি, ট্রলারের ১৭টি ড্রাম ভেসে উঠেছে। সঙ্গে লম্বা বাঁশ পেয়ে যাওয়ায় ড্রামের সঙ্গে বাঁশটি লম্বা করে বাঁধি। সেটা ধরেই সকলে ভাসতে থাকি।’’
দিন যায়, রাত যায়। কানু সঙ্গীদের ক্লান্ত হয়ে পড়তে দেখেন। একে একে সকলের হাত বাঁশ থেকে ছেড়ে সরে যায়। সেই তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ভোলার নয়, বলছেন কানু। তাঁর কথায়, ‘‘তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছিল। সমুদ্রের নোনা জল মুখে তোলার উপায় ছিল না। হাঁ করে বৃষ্টির জল খেয়ে তেষ্টা মেটাই। ওঁরা ভেসে গেলেন। বাঁচাতে পারলাম না।’’
১০ জুলাই, দুর্ঘটনার চার দিন পরে একটি বাংলাদেশি জাহাজ ‘লাইফ জ্যাকেট’ দিয়ে কানুকে টেনে তোলে। শনিবারই তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যান সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা এবং কাকদ্বীপ মৎস্যজীবী সমিতির পক্ষে বিজন মাইতি। তাঁর চিকিৎসার খরচ সরকার বহন করবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য চার চিকিৎসককে নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড তৈরি হয়েছে হাসপাতালে। বোর্ডের সদস্য আশিস মণ্ডল ও অরিজিৎ সাহা জানান, রবীন্দ্রনাথের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত ছাড়া হবে না।
অষ্টম শ্রেণি পাশ ওই যুবকের বাবাও ছিলেন মৎস্যজীবী। সংসারের হাল ধরতে ১০-১৫ বছর ধরে সমুদ্রে যাচ্ছেন কানুও। বংশ পরম্পরায় এই ঝুঁকির পেশাই তাঁরা বেছে নেন। আবার কি স্বামীকে সমুদ্রে যেতে দেবেন? প্রশ্নের উত্তরে এ দিন রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী বন্দনা বলেন, ‘‘উপায় কী? সমুদ্রে না-গেলে পেট চলবে? আপাতত কিছু দিন হয়তো যাবে না। তার পরে বিপদ জেনেও পাড়ি দিতে হবে মাঝসমুদ্রে।’’