পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে ত্রাণের ত্রিপল ও জবকার্ড দেওয়ার অভিযোগপত্র গ্রামবাসীর(বাঁ দিকে)। পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে একনায়কতন্ত্রের অভিযোগপত্র আট পঞ্চায়েত সদস্যের।— নিজস্ব চিত্র
‘রেসিডেন্সিয়াল’ শংসাপত্রের জন্য ‘দিতে হবে’ ১০০ টাকা। ত্রাণের ত্রিপল পেতে ‘খরচ’ ২০০ টাকা। ১০০ দিনের প্রকল্পে জব-কার্ড করাতে ‘লাগবে’ ১,০০০ টাকা। ‘কন্যাশ্রী’ ও ‘রূপশ্রী’ প্রকল্পের শংসাপত্র পেতেও হাজারখানেক টাকা। দরাদরি চলবে। ৫০-১০০ টাকার ছাড়ও মিলতে পারে।
সাধারণ ‘রেট-কার্ড’ নয়। বিনা খরচের নানা সরকারি প্রকল্পের সুযোগ পেতে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে তৃণমূল পরিচালিত বেলশুলিয়া পঞ্চায়েতের প্রধান এবং সদস্যদের একাংশকে কার্যত এমনই ‘প্রণামী’ দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। সম্প্রতি বাসিন্দাদের একাংশ প্রধানের বিরুদ্ধে বেনিয়মের অভিযোগ জমাও দিয়েছেন বিডিও-কে।
শুধু কি সাধারণ মানুষ?
প্রধানের বিরুদ্ধে বিডিও-কে আলাদা অভিযোগ জানিয়েছেন দলেরই আট পঞ্চায়েত সদস্য এবং দলের বুথ কমিটি। প্রধান ওই বিক্ষুব্ধ সদস্যদের বিরুদ্ধে পাল্টা দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়েছেন দলের অঞ্চল সভাপতিকে (ঘটনাচক্রে, তাঁর বিরুদ্ধেও টাকা চাওয়ার অভিযোগ রয়েছে)।
সব মিলিয়ে তফসিলি ও সংখ্যালঘু প্রধান বেলশুলিয়া পঞ্চায়েত ‘দাদা-দিদিদের’ কার্যকলাপে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। বিডিও (বিষ্ণুপুর) স্নেহাশিস দত্ত জানিয়েছেন, তদন্ত চলছে।
বেলশুলিয়া পঞ্চায়েত এলাকার প্রায় চার দিকে শালগাছের ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের পাতা-কাঠ কুড়িয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিন চলে এলাকার বেশির ভাগ মানুষের। আদিবাসী প্রধান এই এলাকায় বাসিন্দাদের অনেকে কাঁচা বাড়িতে থাকেন। কারও চাল খড়ের, কারও ভাঙা টিনের। একশো দিনের প্রকল্পে যে কাজ মেলে না, তা নয়। তবে তা অনিয়মিত বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। এই পরিস্থিতিতে খেতমজুরি, দিনমজুরিই ভরসা।
২০১৮ সালে এ হেন বেলশুলিয়ার ১৩টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে তৃণমূল। গত ২৪ জুন ন’জন গ্রামবাসী বেলশুলিয়ার পঞ্চায়েত প্রধান কৃষ্ণা সর্দারের বিরুদ্ধে বিডিও-র কাছে প্রথম অভিযোগ করেন। তাঁদের দাবি, তিনি জব-কার্ড করানো থেকে ত্রিপল বিলি, এমনকি পশুপালনের ঋণের ব্যবস্থা করতেও টাকা নিচ্ছেন। একই দিনে প্রধানের বিরুদ্ধে বিডিও-র কাছে কার্যত একই অভিযোগপত্র জমা দেন পঞ্চায়েতের আট তৃণমূল সদস্য (পরে দু’জন অভিযোগ প্রত্যাহার করেন)।
বিডিও-র কাছে অভিযোগ জমা দিলেন কেন? কী ঘটেছে? বগডহরা গ্রামের বাসিন্দা ইয়াসিন শেখের দাবি, ‘‘টাকা না ফেললে এখানে কোনও কাজ হয় না। সবটাই গা-জোয়ারি। নতুন জব-কার্ড করাতে গেলে পঞ্চায়েত প্রধান এক হাজার টাকা চাইছেন।’’ আর এক বাসিন্দা কল্যাণ কাপড়ির দাবি, ‘‘ত্রাণের ত্রিপল পিছু প্রধান ২০০ টাকা করে নিচ্ছেন।’’
অভিযোগ সমর্থন করে প্রধানের বিরোধী গোষ্ঠীর পঞ্চায়েত সদস্য আবু তাহের মণ্ডল, বকুল সর্দার, সুনীল পাত্রের দাবি, ‘‘কন্যাশ্রী-রূপশ্রী প্রকল্পের উপভোক্তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে টাকা নিচ্ছেন প্রধান। আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ-সাহায্য পেতেও প্রধান ও তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি মান্নান কোটালকে টাকা দিতে হচ্ছে।’’ এমনকি, ৩ জুলাই বিডিওকে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নিতে আর্জি জানিয়েছেন তৃণমূলের স্থানীয় আধকাটা বুথ কমিটির সভাপতি জহুর আলি খান, খড়কাটা বুথের সভাপতি রয়সুদ্দিন মণ্ডল।
ঘটনা হল, সুনীল, আবু তাহেরদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ যথেষ্ট। খড়কাটা গ্রামের যুবক জিয়ারুল খানের অভিযোগ, ‘‘আগে একশো দিনের প্রকল্পে সুপারভাইজ়ারের কাজ দেওয়ার জন্য পঞ্চায়েত সদস্য সুনীল পাত্র আমার থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। এখন অন্য কাজের সুপারভাইজ়ার হওয়ার জন্য ২০ হাজার টাকা চেয়েছেন।’’ বগডহরা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল মণ্ডলের অভিযোগ, ‘‘বছরখানেক আগে ত্রাণের ত্রিপল দিতে পঞ্চায়েত সদস্য আবু তাহের মণ্ডল আমার কাছ থেকে দু’-একশো টাকা করে নিয়েছেন। এখন অনেকের নজর পড়েছে বলে টাকা নেওয়া বন্ধ।’’
মুখ খুলেছেন প্রধান কৃষ্ণাদেবীও। তাঁর দাবি, ‘‘আবু তাহের মণ্ডল, বকুল সর্দারেরা টাকা নিয়ে ত্রিপল বিলি করেছেন বলে মৌখিক অভিযোগ এসেছে। রূপশ্রী ও কন্যাশ্রী প্রকল্পের আবেদনকারী অবিবাহিত কি না তা নিশ্চিত করতেও ওই দু’জন টাকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ পেয়েছি। দুর্নীতি রুখতে রূপশ্রী ও কন্যাশ্রী প্রকল্পের দায়িত্ব হাতে নিয়েছি। অঞ্চল সভাপতিকে সব লিখিত জানিয়েছি।’’ আবু তাহেররা আবার পাল্টা বলছেন, ‘‘বিডিও-র কাছে অভিযোগ জানিয়েছি বলে প্রধান আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছেন।’’ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন সুনীল পাত্রও।
তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি মান্নান কোটালেরও দাবি, ‘‘আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হচ্ছে। প্রমাণ থাকলে, পঞ্চায়েত সদস্যেরা প্রশাসনের কাছে পেশ করুন।’’
এত দলাদলি, এত লিখিত অভিযোগ। পঞ্চায়েতে ‘প্রণামী’ বন্ধে দল কী করছে? তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি তথা জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি শুভাশিস বটব্যাল এক কথায় বলে দিচ্ছেন, ‘‘দুর্নীতি প্রমাণিত হলে প্রশাসনিক ও দলগত ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
কিন্তু ‘উলুখাগড়াদের’ প্রশ্ন, আর কবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
গুজিশোলের সম্বরি সরেন, পানমুনি মুর্মু, জিতেন সরেনরা তো হাত জোড় করে বলে দিচ্ছেন, ‘‘জানি, টাকা না দিলে কাজ হবে না। ফলে, চাল ফুটো হয়ে বৃষ্টি পড়লে পড়বে, কিন্তু পঞ্চায়েতে যাব না।’’
কারণ, তাঁরা তো দেখেছেন প্রতিবেশী শম্ভু সরেনকে। যিনি মাথা চাপড়ান আর বলেন, ‘‘সরকারি প্রকল্পে বাড়ি পাওয়ার কথা ছিল। পঞ্চায়েতে দেখা করতে গেলে তৃণমূলের নেতারা বললেন, ‘১০ হাজার টাকা দিলে, বাড়ি হবে।’ দিতে পারিনি। বাড়িও হয়নি।’’
তদন্ত চলছে।