বগটুই-য়ে কেন পালানো গেল না? কোনও কোনও মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে, এ ক্ষেত্রেও অসহায় মানুষগুলো যাতে বাইরে বেরোতে না পারেন, তার জন্য বাইরে থেকে নাকি শিকল তুলে দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ।
ভাদু শেখের বাড়িতে ফিরহাদ হাকিম। মঙ্গলবার। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে ২১ বছর। তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য। তোলপাড় হয়েছিল দেশ। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার উপান্তে ছোট এক গ্রাম উঠে এসেছিল শিরোনামে। গ্রামের নাম ছোট আঙারিয়া। আজ, বীরভূমের রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের ঘটনা ফিরিয়ে এনেছে সেই গ্রামের নাম, স্মৃতি।
২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি। ছোট আঙারিয়ায় বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে গোপনে বৈঠক চলছিল। বাইরে থেকে গুলি করে এবং শেষে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ১১টি দেহ। অভিযোগ, বাম জমানায় গড়বেতার মাটিতে লাল বিরোধিতার খেসারত দিতে হয় সেই মানুষগুলোকে। তার পর থেকে এ রাজ্যে এ ভাবে এক বাড়ির ভিতরে একসঙ্গে এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
২০২২ সালের ২২ মার্চ রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার হল পুড়ে যাওয়া সাতটি দেহ। সে দিন পাওয়া গিয়েছিল যুবকদের দেহ। আর এ দিন যে দেহগুলি পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে এক নাবালিকা-সহ ৬ জন মহিলার দেহওও! কী ভাবে মৃত্যু হল এঁদের? আটকে রেখে আগুন দেওয়া হয়েছিল নাকি অন্য কিছু— লোকমুখে এমন নানা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করলেও প্রকৃত ঘটনা এখনও জানা যায়নি। তদন্তে নেমেছে সিআইডি। তবে, ঘটনাক্রম থেকে এটুকু পরিষ্কার, আগুনের লেলিহান শিখা গিলে খেয়েছে দেহগুলিকে। ঠিক যেমন ছোট আঙারিয়ায় হয়েছিল।
আগুন লাগলে স্বাভাবিক নিয়মে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে মানুষ। প্রশ্ন উঠেছে, বাড়িতে আগুন লাগলেও বগটুই গ্রামের ওই মহিলা-পুরুষরা পালানোর চেষ্টা কেন করলেন না? সে বার ছোট আঙারিয়ায় সে উপায় ছিল না। অভিযোগ, লাল দলের তৎকালীন জেলা সম্পাদকের মদতেপুষ্ট দুই শক্তিমান নেতা বাইরে নাকি পাহারায় ছিলেন। শোনা যায়, ওই ঘটনায় নাকি সাহায্য নেওয়া হয়েছিল মাওবাদীদের। নিন্দুকে বলেন, সেই প্রথম এ রাজ্যে মাওবাদীদের পদার্পণ।
বগটুই-য়ে কেন পালানো গেল না? কোনও কোনও মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে, এ ক্ষেত্রেও অসহায় মানুষগুলো যাতে বাইরে বেরোতে না পারেন, তার জন্য বাইরে থেকে নাকি শিকল তুলে দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ। আঙারিয়ার ক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক বিরোধিতার। কেশপুর-গড়বেতা-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিরোধিতার স্বর মুছে দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছিল। অভিযোগ, এ রাজ্যের পুলিশের উপরে তখনও নিরপেক্ষ তদন্তের ভরসা ছিল না। পরে সিবিআই তদন্তভার নেয়, আদালতে গণহত্যার অভিযোগ আনে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দুই নেতাকে গ্রেফতার করে ঘটনার ছ’বছর পরে। ছোট আঙারিয়ায় সেই রাতে ‘খুন’ হয়েছিলেন পাশের হেতোশোল গ্রামের তৃণমূল কর্মী জয়ন্ত পাত্র। এ দিন তাঁর কাকিমা কৃষ্ণা পাত্র বলেন, ‘‘সিপিএম সে বার গণহত্যা চালিয়েছিল। এত বছর হয়ে গেল, বিচার পেলাম না। প্রধান অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছে। আমরা হতাশ।’’ আখতার আলি খান বলেন, ‘‘রামপুরহাটের ঘটনায় তবুও মৃতদেহ গুলো পাওয়া গিয়েছে, আমাদের গ্রামে দেহ গুলোই তো এখনও মেলেনি। একুশ বছর হয়ে গেল, এখনও দোষীরা শাস্তি পেল না। বিচারও শেষ হল না।’’
আখতারের ভাই হায়দারকে সেই রাতে বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। গড়বেতার তৎকালীন দাপুটে নেতা-মন্ত্রী, বর্তমানে সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক সুশান্ত ঘোষ পাল্টা বলেন, ‘‘ছোট আঙারিয়ার ঘটনাও ছিল তৃণমূলের ষড়যন্ত্র, সিপিএমকে ফাঁসানোর কায়দা। যা আদালতে প্রমাণ হওয়ায় বেকসুর ছাড়া পেয়ে যান অনেকেই।’’ এ বার? এখনও পর্যন্ত বগটুইয়ে রাজনৈতিক বিরোধিতার তত্ত্ব দাঁড়ায়নি। ঘটনার আগের রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন শাসক দলের নেতা, উপপ্রধান। তারই ফল এই অগ্নিকাণ্ড? উপপ্রধান খুনের আক্রোশই যদি কারণ হয়, তা হলে তার বলি কেন মহিলারা?