সুচপুর গণহত্যা ঘটেছিল যে জেলায়, সেই বীরভূমেরই বগটুই গ্রামে আট জনের মৃত্যুর এই ঘটনা নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়। উঠল ৩৫৬-র দাবিও। কী ঘটেছিল, কী ভাবে আগুন লাগল—৭২ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
এই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় মৃতদেহগুলি। —নিজস্ব চিত্র।
তৃণমূল শাসিত পঞ্চায়েতের উপপ্রধানকে বোমা মেরে খুন করা হল সোমবার রাতে। তার ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতে এক বাড়িতেই পুড়ে খাক সাত জন। তাঁদের মধ্যে এক নাবালিকা, পাঁচ জন মহিলা, এক যুবক রয়েছেন। এ ছাড়াও এক মহিলা মারা গিয়েছেন হাসপাতালে।
সুচপুর গণহত্যা ঘটেছিল যে জেলায়, সেই বীরভূমেরই বগটুই গ্রামে আট জনের মৃত্যুর এই ঘটনা নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়। উঠল ৩৫৬-র দাবিও। কী ঘটেছিল, কী ভাবে আগুন লাগল—৭২ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মঙ্গলবার সাত জনের দেহ উদ্ধারের পরেই এডিজি (সিআইডি) জ্ঞানবন্ত সিংহের নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করে নবান্ন। রাতে দলটি গ্রামে যায়। দ্রুত ‘ক্লোজ়’ করা হয় রামপুরহাটের আইসি ত্রিদীপ প্রামাণিক এবং এসডিপিও সায়ন আহমেদকে। রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালব্য জানান, ওই ঘটনায় ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক যোগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন ডিজি। যদিও অনেকেরই মনে পড়েছে, ২০০১ সালে ছোট আঙারিয়ায় বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে আগুন লাগানো এবং ১১টি দেহ উদ্ধারের ঘটনার কথা।
বগটুইয়ে তৃণমূলের উপপ্রধান ভাদু শেখকে বোমা মেরে খুন করা হয় সোমবার রাতে। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, ওই খুনের পরেই কয়েকটি বাড়িতে ‘আগুন লাগে’। গ্রামের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা সোনা শেখের একতলা পাকা বাড়িতেও আগুন লাগে। সেই বাড়ি থেকেই এ দিন পাওয়া যায় ৭টি দগ্ধ দেহ। দেহগুলি এতটাই পুড়ে যায় যে চেনা প্রায় অসম্ভব ছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কারও নাম-পরিচয় পুলিশও জানায়নি। রাতে বিশেষ সূত্রে মৃতদের নাম জানতে পারা যায়। মৃতদের মধ্যে সোনা শেখের স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়েরা রয়েছেন। নলহাটি থানার কোগ্রামের এক বাসিন্দা লিখিত ভাবে রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধানের কাছে লিখিত ভাবে দাবি করেন, মৃত সাত জনই তাঁর পরিচিত। তিনি লিখিত ভাবে তাঁদের নাম জানিয়ে শেষকৃত্যের আবেদন জানান। রাতে বগটুই গ্রামে পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতে শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করা হয়।
মৃতদের নাম
• জাহানারা বিবি (৩৮)
• লিলি খাতুন (১৮)
• শেলি বিবি (৩২)
• তুলি খাতুন (৭)
• নুন্নেহার বিবি (৫২)
• রূপালি বিবি (৩৯)
• মীনা বিবি (৩৫)
• সাজিদ শেখ (২২)
গ্রামবাসীদের দাবি, যে সব বাড়িতে আগুন লাগে, সোনা-সহ ওই সব বাড়ির বাসিন্দারা ভাদু-বিরোধী বলেই পরিচিত। গ্রাম সূত্রে জানা যাচ্ছে, অগ্নিসংযোগের সময় সোনা শেখের বাড়িতে ‘আশ্রয়’ নিয়েছিলেন পুরুষ-মহিলা-শিশু সহ অন্তত ৯ জন। রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালব্য বলেন, ‘‘ওখানে উপপ্রধান খুন হয়েছেন বলে লোকজন উত্তেজিত হয়েছিলেন কি না, না অন্য কারণে তা হয়েছে, সেটা দেখা হচ্ছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘যা হয়েছে, সোমবার খুন হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই হয়ে গিয়েছিল। আগুন কী ভাবে ধরেছিল, আমরা বার করার চেষ্টা করছি।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন গ্রামবাসীর দাবি, সোনা শেখের বাড়িতে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভস্মীভূত সেই বাড়ির বাইরে এ দিন একটি ভাঙা তালাও পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে।
মৃত ৮ জনের মধ্যে রয়েছেন পূর্বপাড়ার বাসিন্দা মিনা বিবি। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর পঁয়ত্রিশের এই মহিলা ভাদু-বিরোধী গোষ্ঠীর অন্যতম ফটিক শেখের স্ত্রী। ফটিক এবং সোনা শেখ, দু’জনেরই নাম ভাদু-খুনের এফআইআরে রয়েছে। সোমবার রাতে ভাদুর বাড়ি লাগোয়া ফটিকের বাড়িতে আগুন লাগানো হয় বলে জানা যাচ্ছে। ভাঙচুরও হয় বলে অভিযোগ। ফটিক গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী মিনাকে বেধড়ক মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। পুলিশ সূত্রেই জানা যাচ্ছে, হাত ও পা ভাঙা অবস্থায় মিনা বিবিকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাঁর শরীরের একাংশ অগ্নিদগ্ধও হয়েছিল বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। পরে হাসপাতালেই তিনি মারা যান। এক নাবালক-সহ আরও তিন জন অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় রামপুরহাট মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই নাবালককে বিকেল থেকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও রাতে সন্ধান মেলে।
এই ঘটনাকে রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্টের ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে’র পরিণতি বলে চিহ্নিত করেছে রাজ্যের শাসক শিবির। এ দিন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিধানসভায় বলেন, ‘‘রামপুরহাটের এই ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এটা বড় রকমের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।’’ ঘটনার তদন্তে রাজ্য সরকার উচ্চ পর্যায়ের বিশেষ দল গঠন করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যারা এই অপরাধ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করা হবে।’’ নবান্ন সূত্রের খবর, রামপুরহাটের ঘটনার সঙ্গে ডেউচা-পাঁচামির খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনের যোগসূত্রও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রামপুরহাট-কাণ্ডে বোমা মারার ঘটনায় এনআইএ তদন্ত এবং খুনের ঘটনার সিবিআই তদন্ত দাবি করেছে বিজেপি। রাজ্যে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবিতে রাজভবনের দ্বারস্থ হয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। দার্জিলিঙের রাজভবনে থাকা রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে বিজেপি বিধায়কদের ভিডিয়ো বৈঠক শেষে বেরিয়ে শুভেন্দু বলেন, “রাজ্যপালের কাছে দু’টো দাবি করেছি। বলেছি, আপনি কেন্দ্রকে বলুন এখানে ব্যবস্থা নিতে। সংবিধানের মধ্যে ৩৫৬ এবং ৩৫৫— দুই ধারাই আছে। রাজ্যপাল বলেছেন, তিনি যা করার, করছেন।’’ রামপুরহাটের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিলেও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবি তোলেনি বামেরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘একের পর এক ঘটনা ঘটবে আর তাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলবে।’’
তাৎপর্যপূর্ণ হল, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই মর্মে এখনও পর্যন্ত কোনও লিখিত অভিযোগ হয়নি পুলিশের কাছে। জেলা পুলিশ একটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করেছে অগ্নিসংযোগের। প্রশ্ন উঠেছে, শাসক দল এক দিকে যখন ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’ দেখছে, সেখানে সেই দলেরই বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এ দিন সকালে দাবি করেন, শর্ট সার্কিটের জন্য ওই বাড়িতে টিভিতে আগুন লেগেছে। এ প্রশ্নও উঠেছে, বেছে বেছে ভাদু-বিরোধী বাড়িতেই শর্ট সার্কিট কেন হবে?
যদিও ভাদুর ভাই জাহাঙ্গির শেখ মেনে নিচ্ছেন, উত্তেজিত হয়ে আগুন লাগানো হয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘দাদাকে আশপাশের প্রতিটা গ্রামের মানুষজন ভালবাসতেন। দাদা খুন হওয়ার সংবাদ পেয়ে হাজার হাজার মানুষ গ্রামে চলে আসেন। সেখানে কে বা কারা সোনা শেখের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে, কী করে বলা যাবে!’’ এ দিন বগটুই গ্রামে পৌঁছে যান মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, রামপুরহাটের বিধায়ক তথা ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূলের জেলা সহ সভাপতি তথা লাভপুরের বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ। তাঁরা প্রথমে সোনা শেখের বাড়ি ও পরে ভাদু শেখের বাড়িতে যান। পরে রামপুরহাটে সার্কিট হাউসে ফিরহাদ বলেন, ‘‘তৃণমূলের বদনাম করার জন্য এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আমাদেরই দলের উপপ্রধানকে খুন করে আমাদের রাজ্যকেই কালিমালিপ্ত করার চক্রান্ত যারা করেছে, তাদের খুঁজে বের করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। রাজ্য পুলিশের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকেরা তদন্ত শুরু করে দিয়েছেন। কাউকে ছাড়া হবে না।’’ জ্ঞানবন্ত সিংহের নেতৃত্বে তিন সদস্যের সিট-এ বাকি দু’জন হলেন আইজি (বর্ধমান রেঞ্জ) ভরতলাল মিনা এবং ডিআইজি (সিআইডি) মিরাজ খালিদ। এডিজি (পশ্চিমাঞ্চল) সঞ্জয় সিংহ-ও এ দিন তদন্তে আসেন বগটুই গ্রামে।