রাজীব সিংহ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
স্বয়ং রাজ্যপাল নজিরবিহীন ভাষায় সমালোচনা করেছেন তাঁর। পেরোতে হয়েছে একাধিক মামলা-মোকদ্দমা। কলকাতা হাইকোর্টের একাধিক বিচারপতি তাঁর সম্পর্কে চোখা-চোখা মন্তব্য করেছেন। এমনকি, প্রধান বিচারপতি এমনও মন্তব্য করেছিলেন যে, কমিশনারের উপর কোনও ‘চাপ’ থাকলে তিনি ইস্তফা দিতে পারেন! সে সব পেরিয়ে অবশেষে শনিবার চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসছেন রাজীব সিংহ।
জুন মাসের ৭ তারিখে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার পদে শপথ নিয়েছিলেন রাজীব। তাঁর শাসনকালে গত এক মাসে শনিবার পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে পঞ্চায়েত ভোট সংক্রান্ত বিবাদ এবং সংঘর্ষে। তবে তথ্য বলছে, গত এক মাসে যা যা ঘটেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে হাই কোর্টের নির্দেশ মানতে ‘বাধ্য’ হওয়া ছাড়া আর প্রায় কোনও কিছুতেই কমিশনের ভাবনা বা সিদ্ধান্তের বদল ঘটাতে হয়নি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিবকে।
লোকসভা ভোটের এক বছর আগে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পঞ্চায়েত ভোট সামলানোর দায়িত্ব কাকে দেওয়া যায়, তা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। দু’তিনটি নাম নিয়ে জল্পনা হচ্ছিল। তার মধ্যে প্রশাসনিক মহলের একাংশের কাছে তাঁর পুরুষ্ট গোঁফজোড়ার জন্য ‘দবং অফিসার’ বলে পরিচিত রাজীবের নামও ছিল। তবে রাজীব গোড়ায় ততটা উৎসাহী ছিলেন না বলেই অসমর্থিত সূত্রের খবর। সেই অসমর্থিত সূত্রের খবর এ-ও যে, শেষমেশ রাজীবকে বুঝিয়ে রাজি করানো গিয়েছিল।
গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
তবে প্রশাসন তাঁর নাম ঠিক করলেও গোড়াতে জট পেকেছিল রাজীবকে নিয়ে। নবান্ন থেকে পাঠানো তাঁর নামে অনুমোদন দিচ্ছিলেন না রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। সেই পর্বে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের চেয়ার কয়েক দিন ফাঁকাও ছিল। তখন থেকেই নবান্ন-রাজভবনের ‘মৃদু সংঘাতে’ পঞ্চায়েত নির্বাচনের সুর বাঁধা হয়ে গিয়েছিল বলেই মনে করেন অনেকে। যা পরের এক মাসে অনেক বেড়েছে। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আস্থাভাজন’ আমলাদের তালিকায় থাকা রাজীবকেই বিদায়ী কমিশনার সৌরভ দাসের স্থলাভিষিক্ত করেন রাজ্যপাল।
দায়িত্ব নেওয়ার পরের দিনই রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে দেন রাজীব। সেই সূচিতে বলা হয়, পর দিন অর্থাৎ ৯ জুন থেকে মনোনয়ন জমা দেওয়া যাবে। মনোনয়ন পর্ব চলবে ১৫ জুন পর্যন্ত। তখন থেকেই বিরোধীরা রুষ্ট ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, মনোনয়নের জন্য অনেক কম সময় দেওয়া হয়েছে। মাঝে আবার একটি রবিবার পড়ায় মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় আরও কমে যাচ্ছে। কমিশনে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ, অবস্থান, স্লোগান। এরই পাশাপাশি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরা আদালতের দ্বারস্থ হন। সেই মামলার শুনানিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং কমিশনারকে বিঁধে কড়া কড়া পর্যবেক্ষণ করেছিল হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম রাজীবের উদ্দেশে বলেছিলেন, “কমিশনারের ওপর কোনও চাপ থাকলে তিনি পদত্যাগ করুন! আদালতের নির্দেশ কার্যকর করতে না পারলে কমিশনারের পদত্যাগ করা উচিত। রাজ্যপাল নতুন কমিশনার নিয়োগ করবেন।”
তবে রাজীব ইস্তফা দেননি। ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বের ‘চাপ’ রয়েছে। কিন্তু তিনি যা করছেন, ‘রুলবুক’ মেনেই। বস্তুত, গত এক মাসে সমস্ত রকমের সমালোচনার মুখেই রাজীব আপাতদৃষ্টিতে নির্লিপ্ত থেকেছেন। কমিশনার হিসাবে জেলায় জেলায় তিনি যে নির্দেশ পাঠিয়েছেন, তা নিয়ে প্রশাসনিক মহলে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু ‘হুকুম’ নড়েনি। যেমন নড়েননি রাজীব নিজেও।
রাজীব যে সমালোচনার মুখে পড়ে ইস্তফা দেননি, তাতে কেউই খুব একটা আশ্চর্য হননি। কারণ, বাংলার আমলা মহলে এ কথা সুবিদিত যে, রাজীব চেয়ার ছাড়েন না! ২০১৩ সালে নিজের বেতনের টাকায় চেয়ার কিনেছিলেন। তার পর থেকে তিনি যে দফতরে গিয়েছেন, সেই চেয়ারটি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। মুখ্যসচিব পদ থেকে অবসর নিয়ে শিল্পোন্নয়ন নিগমে যাওয়ার দিন নবান্নে সাংবাদিকদের তাঁর ওই চেয়ার না-ছাড়ার গল্প শুনিয়েছিলেন রাজীব। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে মুখ্যসচিবের দায়িত্ব ছেড়েছিলেন। কিন্তু চেয়ারটি ছাড়েননি।
বলতে গেলে রাজীবকে ‘আপস’ করতে হয়েছে একটি বিষয়েই— পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা। প্রথম থেকেই রাজীবের অধীন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করাতে চায়নি। তবে এই ইতিহাস নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন ভোটে বাংলায় এমন দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছে যে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন রাজ্য পুলিশের উপরেই আস্থা রেখেছে। এ বারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাজ্য পুলিশের পাশাপাশি বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড থেকে পুলিশ এনে পঞ্চায়েত ভোট করাতে চেয়েছিল কমিশন। কিন্তু আদালত স্পষ্ট নির্দেশ দেয়, ‘স্পর্শকাতর’ এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করেই পঞ্চায়েত ভোট করাতে হবে। সেই নির্দেশ পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছিল কমিশন। তাতে আরও কড়া নির্দেশ দিয়ে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ বলে, শুধু ‘স্পর্শকাতর’ এলাকাই নয়, কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ— কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করেই পঞ্চায়েত ভোট করাতে হবে। অনেকে ভেবেছিলেন ওই নির্দেশের পর কমিশন সুপ্রিম কোর্টে যাবে। তার ভিত্তিতে শুভেন্দু থেকে কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু) শীর্ষ আদালতে ‘ক্যাভিয়েট’ও দাখিল করে রেখেছিলেন। কিন্তু কমিশন আর শীর্ষ আদালতে যায়নি।
কিন্তু রাজভবনের সঙ্গে রাজীবের টানাপড়েন জারি থেকেছে। মাঝখানে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে রাজীবের যোগদানপত্র (জয়েনিং লেটার) গ্রহণ না করে তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যপাল। অনেকে ভেবেছিলেন, রাজীব ইস্তফা দিতে পারেন। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা নির্বাচন কমিশনারের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “রাজীবকে সরানো অত সস্তা নয়! উনিই (রাজ্যপাল) ফাইলটা ক্লিয়ার করেছিলেন। উনিই শপথগ্রহণ করিয়েছিলেন।”
দেখা যাচ্ছে, চেয়ারের পাশাপাশিই গত এক মাসে রাজীব যা যা নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেগুলি থেকেও তাঁকে পিছু হটতে হয়নি। বিরোধীদের মামলার অন্যতম আর্জি ছিল, মনোনয়নের সময়সীমা বাড়াতে হবে। কিন্তু তা হয়নি। কমিশনের দেওয়া সময়সীমাই বহাল থেকেছে। ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি মামলা রুজু করে আর্জি জানিয়েছিলেন, ভাঙড়ের ৮২ জনকে মনোনয়ন দেওয়ানোর বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। আদালতের নির্দেশের পরেও পুলিশ নিরাপত্তা দিতে পারেনি। সেই মামলায় সিপিএমও ‘পক্ষ’ হয়ে দাবি জানিয়েছিল, ক্যানিংয়ে তাদের ১৯ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করতে পারেননি। তাঁদেরও সুযোগ করে দেওয়া হোক। বিচারপতি অমৃতা সিংহ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ২৮ জুনের মধ্যে ‘বঞ্চিত’দের মনোনয়ন দাখিল করার বন্দোবস্ত করতে হবে কমিশনকে। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গল বেঞ্চের রায় খারিজ করে দেয়।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিবিআইকেও সামলাতে হয়েছে নির্বাচন কমিশনার রাজীবকে। আমতার দুই সিপিএম প্রার্থী আদালতে অভিযোগ করেন, তাঁদের নথি বিকৃত করে স্ক্রুটিনিতে মনোনয়ন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সেই মামলায় বিচারপতি অমৃতা সিংহ সংশ্লিষ্ট বিডিওর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায় নির্বাচন কমিশন। সিবিআই তদন্তে স্থগিতাদেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ।
এর পর আসে ভোটের দফা নিয়ে মামলা। বিরোধীরা আদালতে মামলা করে আর্জি জানিয়েছিলেন, পঞ্চায়েত ভোট কয়েক দফায় ভেঙে দেওয়া হোক। কিন্তু শুনানির শেষে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বিবিধ পর্যবেক্ষণ জানালেও নির্দেশনামায় বলেছে, ক’দফায় ভোট হবে, তা ঠিক করার এক্তিয়ার একমাত্র নির্বাচন কমিশনেরই রয়েছে। সেখানে আদালত কিছু ‘পরামর্শ’ দিতে পারে। কিন্তু কমিশনের কাজে নাক গলাতে পারে না।
আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত নির্দেশ বাদ দিয়ে সে ভাবে আর কোনও বিষয়েই রাজ্য নির্বাচন কমিশন তথা কমিশনারকে বড় ‘ধাক্কা’ খেতে হয়নি। অনেকেই ভেবেছিলেন, নির্বাচন কমিশনার হিসাবে রাজীব আইনি জটিলতায় পড়বেন। কিন্তু তা হয়নি।
তবে অনেকেরই বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনার হিসাবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিষয়টি ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে আইনি ‘জয়’ পেলেও রাজীবকে ঘিরে যে ‘বিতর্ক’ তৈরি হয়েছে, তা ‘অনভিপ্রেত’। যেমন মক্কায় বসে মিনাখাঁয় মনোনয়ন দাখিলের মামলায় খানিকটা ‘বিড়ম্বিত’ই হতে হয়েছে কমিশনার তথা কমিশনকে। অথবা রাজ্যপাল যখন বলছেন, ‘‘আপনার হাতে যে রক্ত লেগে রয়েছে, তা গঙ্গার সমস্ত জলে ধুলেও যাবে না’’, তখন সেটি কমিশন বা কমিশনার সম্পর্কে জনমানসে খুব ভাল ধারণা তৈরি করে না।
তবে রাজীবের পরীক্ষা শনিবারেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আগামী মঙ্গলবার ভোটের গণনা। ব্যালট পেপারে ভোট হওয়ায় গণনা এক দিনেই শেষ হওয়া দুষ্কর। ফলে ফলপ্রকাশ পর্যন্ত রাজীব আতশকাচের তলায় থাকবেন। বিশেষত, আদালত যখন নির্দেশ দিয়েছে, ভোটের ফলপ্রকাশের পরেও ১০ দিন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে রাজ্যে থাকতে হবে। তত দিন পর্যন্ত রাজীবের চেয়ার ‘হট সিট’ই থাকবে!