হয় শিলিগুড়ি জংশন, নয়তো নিউ জলপাইগুড়ি (এনজেপি)। রাজ্য তো বটেই, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে সব ট্রেন উত্তরবঙ্গে আসে, তাদের এই দু’টি স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। ট্রেনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে স্টেশন দু’টিতে বাড়ছে জটও। এই জট ছাড়াতে কিছু লোকাল ট্রেনকে বাইপাস লাইন দিয়ে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে রেল মন্ত্রক। সে জন্য তারা দু’টি বাইপাস লাইনও করতে চাইছে এই স্টেশন দু’টির কাছে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জবরদখলকারীরা। সম্প্রতি সেই জবরদখল তুলতে রাজ্যের কাছে সাহায্য চাইলেন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু। এই নিয়ে অনুরোধ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখেছেন তিনি।
দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরে মমতা এর মধ্যেই জবরদখলকারীদের প্রতি কড়া হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। সাম্প্রতিক উত্তরবঙ্গ সফরের সময় তিনি জানিয়েছেন, সরকারি জমি নতুন ভাবে কেউ জবরদখল করে বসলে, তাকে তুলে দেওয়া হবে। যদিও পুরনো দখলকারীদের প্রতি সরকার কী অবস্থান নেবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে প্রভুর এই চিঠি নিয়ে যে রাজ্য প্রশাসন ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করছে, তার ইঙ্গিতও নবান্ন সূত্রে মিলেছে। বস্তুত, দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীই। তাই রেল মন্ত্রক আশাবাদী, উত্তরবঙ্গের এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ বার রাজ্যের সহায়তা মিলবে।
রেল মন্ত্রক কেন বাইপাস লাইন করতে চাইছে? মন্ত্রক সূত্রে বলা হয়েছে, নিউ জলপাইগুড়ি এখন ‘এ ক্যাটেগরি’ স্টেশন। রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন তো বটেই, এনজেপি উত্তর-পূর্বের ‘গেটওয়ে’-ও বটে। অসমের মতো উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে যে সব ট্রেন যায়, সেগুলি এনজেপি হয়েই যাতায়াত করে। এমনকী, গুয়াহাটি রাজধানীও এই পথ দিয়েই যায়। একই সঙ্গে গুরুত্ব বাড়ছে শিলিগুড়ি জংশনেরও।
শুধু মেল বা এক্সপ্রেস নয়, এই দুই স্টেশন দিয়ে আবার লোকাল ট্রেনও অহরহ যাতায়াত করছে। ফলে অনেক সময়েই এনজেপি বা শিলিগুড়ি জংশনে ট্রেন-জট তৈরি হয়ে যায়। সেই জট কাটাতে দক্ষিণ থেকে আসা ট্রেনগুলিকে বহু ক্ষেত্রেই রাঙ্গাপানি স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। উত্তর বা উত্তর-পূর্ব থেকে আসা ট্রেনগুলিকে দাঁড় করানো হয় আমবাড়ি ফালাকাটা স্টেশনে।
রেল এখন চাইছে এই ট্রেন-জট কাটিয়ে পথে গতি আনতে। এর পিছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, এর ফলে দূরপাল্লার মেল ও এক্সপ্রেস ট্রেনগুলিকে সময় মতো চালানো যাবে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রেল যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত হওয়া জরুরি। কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রে বলা হচ্ছে, চিনের বাড়বাড়ন্তের মাথায় রেখে এখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শক্তি বাড়াতে চাইছে দিল্লি। সে জন্যই এই লাইনে জট যত কম হয়, ততই ভাল।
রেল সমীক্ষা করে দেখেছে, শিলিগুড়ি জংশনের কাছে ৩০৪টি এবং শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের কাছে ৭০টি পরিবার রেলের জমি জবরদখল করে রয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই ঘরবাড়ি করে ফেলেছে তারা। এই দখল ভাঙতেই রাজ্যের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। এই দখল সরিয়ে প্রকল্প শুরু করতে না পারায় উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের জেনারেল ম্যানেজার এবং ওই রেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আলাদা করে চিঠি দেন এ রাজ্যের মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে। তাতে কাজ না হওয়ায় শেষমেশ বাধ্য হয়েই মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি লিখেছেন রেলমন্ত্রী।
চিঠিতে সমস্যার কথা জানিয়ে মমতাকে রেলমন্ত্রী বলেছেন, ‘আপনিও জানেন রেল চালাতে গেলে কী ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয়।’ রেল বোর্ডের কর্তাদেরও বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীও জানেন, রেলের ওই প্রকল্পের কতটা প্রয়োজন।’’ একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তো নিজেই উত্তরবঙ্গে উন্নয়ন চান। তাই বারবার ছুটে যান ওখানে। তাই আমরা আশাবাদী, প্রকল্পের জট খুলবেই।’’
বাইপাস দু’টি হলে কাজের কী সুবিধা হবে? রেল সূত্রে বলা হচ্ছে, তখন দক্ষিণ দিক থেকে আসা ট্রেনগুলি আলুয়াবাড়ি রোড থেকে বাগডোগরা ও মাটিগাড়া হয়ে সোজা সেবক চলে যেতে পারবে। শিলিগুড়ি জংশনে তাদের ঢুকতে হবে না। অন্য দিকে, উত্তর-পূর্ব থেকে আসা ট্রেনগুলি আমবাড়ি-ফালাকাটার পরে বাইপাস হয়ে শিলিগুড়ি টাউন ও শিলিগুড়ি জংশনে চলে যেতে পারবে। এর জন্য তাদের এনজেপি ঘুরে যেতে হবে না।
জট খোলার এই প্রস্তাব বিধানসভা ভোটের জন্য কয়েক মাস আটকে ছিল রাজ্য প্রশাসনের ঘরে। এখন নতুন সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, সে দিকেই সাগ্রহে তাকিয়ে সুরেশ প্রভুর মন্ত্রক।