কয়েক দিন আগেই রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়ে দিয়েছিল, পুরভোটে আধা-সামরিক বাহিনী পাঠানো সম্ভব নয়। এখন মত বদলে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোরই সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে তারা। কিন্তু প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হওয়ার আগেই বাহিনী আসার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিয়েছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। পুরভোটের মুখে বিতর্ক বেধেছে তাঁর এই ঘোষণা নিয়েই। প্রশ্ন উঠেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কথা রাজ্য সরকার বা নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানোর আগেই কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা কি এ ভাবে তা প্রকাশ্যে বলে দিতে পারেন?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, সোম-মঙ্গলবারের মধ্যে এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়ে তাদের নতুন অবস্থান জানিয়ে দেবে দিল্লি। মন্ত্রকের এক কর্তা জানান, ১৮ এপ্রিল কলকাতা পুরসভা এবং ২৫ এপ্রিল রাজ্যের ৯১টি পুরসভা নির্বাচনের জন্য ৭০ থেকে ৮০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর চেষ্টা হচ্ছে। কেন্দ্রের এই নতুন সিদ্ধান্তের বিষয়ে শনিবার পর্যন্ত তাঁদের কাছে অবশ্য কোনও খবর নেই বলে জানিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের এক শীর্ষ কর্তা।
পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার পক্ষপাতী ছিল না রাজ্য সরকার। কিন্তু বিরোধীদের লাগাতার দাবি এবং নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিক আর্জির প্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তবে শেষ লগ্নে চিঠি পেয়ে আর বাহিনী পাঠানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাতে বিড়ম্বনায় পড়েছিল বিজেপি। কারণ, রাজ্যে সন্ত্রাস নিয়ে রাজ্য বিজেপি-র অভিযোগে তাদেরই পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ কান দিচ্ছে না বলে বার্তা গিয়েছিল। এখন আবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের কাছ থেকে তিনি বাহিনী পাঠানোর আশ্বাস পেয়েছেন বলে রাহুলবাবু
বলে দেওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েছে বিজেপি-ই। কারণ, রাজনৈতিক স্তরে যে এমন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা যায়, তা সামনে এনে ফেলেছেন তিনি! রাজনৈতিক নেতাদের এক্তিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছেন।
পুরভোটের মুখে সন্ত্রাসের অভিযোগ নিয়ে চাপানউতোর চলার মাঝেই শনিবার বহরমপুরে দলের জেলা কার্যালয়ে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুলবাবু বলেন, “রাজ্যের পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর বিষয়ে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে আমার কয়েক দফা কথা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর বিষয়ে তিনি সহমত হয়েছেন। এ রাজ্যের পুরভোটের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর বিষয়ে তিনি আমাকে নিশ্চিত করেছেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী আসছেই।” কত কোম্পানি বাহিনী আসবে, তা অবশ্য নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি রাহুলবাবু। বিজেপি সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে না জেনে শাসক দল যে ভাবে ‘বাড়াবাড়ি’ করছে, সেই বিপদের কথা রাজনাথকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন রাহুলবাবুরা। তার পরেই মত বদলেছে। কিন্তু বিতর্ক বেধেছে এ ব্যাপারে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই রাহুলবাবুর বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসায়।
রাজ্যের মন্ত্রী এবং তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সরাসরিই রাহুলবাবুর বক্তব্যকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘উনি তো রাজ্য বা নির্বাচন কমিশনের কেউ নন! তা হলে এমন ঘোষণা তিনি করেন কী ভাবে? আর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকই বা কী রকম, যারা রাজ্যের সঙ্গে কথা না বলেই শুধু শাসক দলের রাজ্য নেতার কথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে?’’ পার্থবাবুর বক্তব্য, দলের নেতা হিসাবে রাজনাথের সঙ্গে রাহুলবাবুদের কথা হতেই পারে। কিন্তু প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক প্রক্রিয়া না মেনে তা প্রকাশ্যে বলা যায় কী ভাবে? শাসক দলের মহাসচিবের কথায়, ‘‘অদ্ভুত একটা দল এসেছে কেন্দ্রের ক্ষমতায়! এরা সংবিধান-প্রশাসন, যুক্তরাষ্ট্রীয় রীতি কিছুই মানে না!’’
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র রাহুলবাবুদের বক্তব্যকে বিশেষ গুরুত্বই দিতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘এক বার বলা হচ্ছে বাহিনী আসবে না, এক বার বলা হচ্ছে আসবে। আমরা আর নির্বাচন কমিশন বা কেন্দ্রীয় বাহিনী কারও ভরসাতেই নেই। লোকসভা ভোটে তো দেখেছি, কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেও রাজ্য সরকার তাদের কী ভাবে ব্যবহার করেছে আর শাসক দল কী ভাবে ভোট করেছে!’’
কলকাতা-সহ রাজ্যের ৯২টি পুরসভার ভোট আধা-সামরিক বাহিনী দিয়ে করানো হবে কি না, তা নিয়ে কিছু দিন ধরেই তৃণমূলের সঙ্গে বিরোধীদের টানাপড়েন চলছিল। রাজ্যের বক্তব্য ছিল, রাজ্যের সশস্ত্র পুলিেশই ভোট করা সম্ভব। পক্ষান্তরে সব বিরোধী দলই কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করার পক্ষে ছিল। সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটের স্বার্থে কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রয়োজন বলে জানিয়ে দেয় কমিশনও। তারা নবান্নের কাছে ১৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর সুপারিশ করে।
এই প্রেক্ষিতে দিল্লির কাছে চিঠি দিয়ে রাজ্য জানতে চায়, তারা কত কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতে পারবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানায়, পশ্চিমবঙ্গ-সহ মাওবাদী-অধ্যুষিত বিভিন্ন রাজ্য এবং কাশ্মীরে আধা-সামরিক বাহিনী থাকায় পুরভোটের জন্য এক কোম্পানিও কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো যাবে না। তবে রাজ্য চাইলে জঙ্গলমহলে মজুত কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ভোটের কাজে লাগাতে পারে। কেন্দ্রীয় বাহিনী পাওয়া যাবে না ধরে নিয়েই এ দিন স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন নির্বাচন কমিশনার। সেখানে স্বরাষ্ট্রসচিব জানান, জঙ্গলমহলে মজুত ৪০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কোনও মতেই সরানো যাবে না। তবে দার্জিলিং পাহাড়ে যে ৮ কোম্পানি আধা-সামরিক বাহিনী রয়েছে, তার মধ্যে দু’এক কোম্পানিকে কলকাতার ভোটে টহলদারির কাজে লাগানো যাবে। পরে নির্বাচন কমিশনার সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘পুরভোটে কিছু কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে ভোটারদের মনে আস্থা বাড়বে। তবে ভোটে সাধারাণত রাজনৈতিক দলগুলিই গণ্ডগোল পাকায়। আমার আবেদন, রাজনৈতিক দলগুলির ‘ভ্রূকুটি’ উপেক্ষা করে মানুষ ভোট দিন।’’
কমিশনের দফতরে এই বৈঠক চলাকালীনই বহরমপুরে বিজেপি নেতা রাহুলবাবু ঘোষণা করেন, পুরভোটে কেন্দ্রীয় সরকার আধা-সামরিক বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দিল্লিতে বিজেপি-র এক সূত্র জানান, পশ্চিমবঙ্গের পুরভোটের জন্য তাদের রাজ্য শাখাই প্রথম ৪০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্র কোনও বাহিনী পাঠাবে না জানানোর পরে এই নিয়ে দলের রাজ্য শাখা রাজনাথের কাছে দরবার করে। তাদের সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাজ্যের নেতারা জানান, তাঁরাই প্রথম কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি তুলেছিলেন। অতএব, দিল্লি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা না করলে তাঁদের মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না! আর বামেরাও বলে যেতে পারবে, তৃণমূল-বিজেপি বোঝাপড়া হয়েছে। রাজ্য নেতাদের যুক্তি ছিল, পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে দলের কর্মীরা চাঙ্গা হবেন। শুধু রাজ্য পুলিশ দিয়ে ভোট করালে তৃণমূল কার্যত ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে কিছুটা হলেও ভোট অবাধ হবে। রাজনাথকে নেতারা জানান, কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো যাবে না বলে দিল্লি জানিয়ে দেওয়ায় দলের কর্মীরাই মনে করছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে তাঁদের তেমন দর নেই! ওই সূত্রের কথায়, ‘‘এই কথার প্রেক্ষিতেই নতুন সিদ্ধান্ত হয়েছে পুরোপুরি রাজনৈতিক স্তরে। এতে সরকারি শিলমোহর পড়বে আগামী সপ্তাহের গোড়ায়।’’
তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ বলছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকলে বিজেপি বরং ভোটে খারাপ ফলের পরে বলতে পারত, রিগিং হয়েছে! এখন নিজেরাই কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার ব্যবস্থা করার কথা বলে দিয়ে নিজেদের রাস্তাই তো বন্ধ করে ফেলল!’’ সম্ভবত পরে বিপাকে পড়তে হতে পারে আন্দাজ করেই রাহুলবাবু কিন্তু এ দিন একই সঙ্গে বলে রেখেছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী পেলেও সন্ত্রাসমুক্ত ভোট হবে কি না, তা নিয়ে তাঁদের সংশয় থাকছেই। তিনি বলেন, “গত পঞ্চায়েত ভোটে কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছিল। তাদের ভাল খাবারের ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের জন্য তাদের কিন্তু সঠিক জায়গায় পাঠানো হয়নি। বসিয়ে রাখা হয়েছিল। এ বারও যদি তা-ই হয়, তবে ভোট করানোর দরকার নেই! কমিশন ভোট বন্ধ করে দিক।’’ কমিশন যাতে সঠিক ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী পরিচালনার নির্দেশ দেয়, সেই দাবিও তুলেছেন রাহুলবাবু।
বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি নির্বাচন কমিশনার। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে এ ব্যাপারে সরকারি তথ্য নেই। নেতাদের কথার প্রেক্ষিতে মন্তব্য করতেও পারি না।’’ স্বরাষ্ট্র দফতরের এক সূত্র জানাচ্ছে, সরকারি ভাবে এখনও নবান্নকে কিছু জানানো হয়নি। তবে রাজ্য ও নির্বাচন কমিশন মিলে ঠিক করেছে, ভোটের দিন প্রতিটি বুথে সশস্ত্র বাহিনী থাকবে। কোনও সিভিক পুলিশ এবং এনভিএফ-কে ভোটের কাজে লাগানো হবে না। কমিশনার জানান, ভোটের দিন এক থেকে তিনটি বুথ নিয়ে তৈরি ভোটকেন্দ্রে দু’জন করে সশস্ত্র পুলিশ থাকবে। বুথের সংখ্যা বেশি হলে চার জন সশস্ত্র পুলিশ এবং এক জন অফিসার থাকবেন।