অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। —ফাইল চিত্র।
সে দিন ৭ অগস্ট, ১৯৪১। ইংরেজি তারিখ অনুসারে অবনীন্দ্রনাথের ৭০তম জন্মদিন। অথচ সে দিন বদলে গিয়েছিল জন্মদিনের তাৎপর্যটাই। এমন বিয়োগান্তক জন্মদিন আগে তো কখনও আসেনি! বেদনা, বিষন্নতায় ভরা সেই দিনটা যেন জীবনের গতি পথটাকেই বদলে দিয়েছিল। কিছু ক্ষণ আগেই রবিকাকা পাড়ি দিয়েছেন অমৃতলোকে। আর শোকে স্তব্ধ ৭০ বছরের অবন ঠাকুর তখন পাঁচ নম্বর বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে আপন মনে এঁকে চলেছেন একটি ছবি— সে ছবি রবিকাকার অন্তিমযাত্রার। ছবিতে শুধু অসংখ্য ঊর্ধমুখী হাতের সারি। তার উপর দিয়ে যেন ভেসে চলেছে রবিকাকার শায়িত মরদেহ। এ যেন ইহলোক থেকে অমৃতলোকের পানে তাঁর যাত্রা। সে ছবি পরে প্রবাসীতে ছাপাও হয়েছিল।
জোড়াসাঁকোর দুই বাড়ির প্রাঙ্গন সে দিন লোকে লোকারণ্য। রবীন্দ্রনাথকে এক বার শেষ দেখা দেখতে উদগ্রীব সকলেই। কিছু পরেই বাড়ির ফটক পেরিয়ে তাঁর দেহ চিরকালের জন্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে, দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি পেরিয়ে চলে যাবে নিমতলা ঘাটে। সেখানেই তার নশ্বর দেহ চিতার লেলিহান শিখায় বিলিন হবে পঞ্চভূতে। অথচ এই রবিকাকাই তো লিখেছিলেন, ‘ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে, অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চোখে আলোকে...’।
আরও পড়ুন: যদি রবিঠাকুর থাকেন!
এই রবিকাকাই তাঁর জীবনে অনেক কিছুর অনুপ্রেরণা। যখন তিনি চিত্রাঙ্গদা লিখেছিলেন তখন অবনীন্দ্রনাথের উপর নির্দেশ এসেছিল ছবি দেওয়ার জন্য। সেই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “...এই হল রবিকাকার সঙ্গে আমার প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ। তার পর থেকে এত কাল রবিকার সঙ্গে বহু বার আর্টের ক্ষেত্রে যোগাযোগ হয়েছে, প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তাঁর প্রেরণা।”
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। —ফাইল চিত্র।
আবার রবীন্দ্রনাথের রাখি বন্ধন ও স্বদেশি অন্দোলনের তিনিই ছিলেন অন্যতম সঙ্গী এবং উদ্যোক্তা। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে তাঁর লেখালেখির শুরু। প্রথমে ‘শকুন্তলা’ লিখে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা পেয়ে তার পরে লিখেছিলেন ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজকাহিনী’, ‘বুড়ো আংলা’ ইত্যাদি। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থ অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “রবিকা বলতেন ‘অবন একটা পাগলা’ সে কথা সত্যি। আমিও এক এক সময় ভাবি, কী জানি কোন্ দিন হয়তো সত্যি খেপে যাব।...চির কালের খ্যাপা আমি। সেই খ্যাপামি আমার গেল না কোনো কালেই।’
তিনিই বেঙ্গল স্কুলের সেই পথিকৃত, যাঁর শিল্পসত্ত্বা জন্ম দিয়েছিল এক নব্যবঙ্গীয় চিত্রকলার রীতির। তিনি সেই শিল্পাচার্য, যাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেঙ্গল স্কুলের পরবর্তী শিল্পীরা এ দেশের আধুনিক চিত্রকলার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। অসামান্য এক শিক্ষক, এসরাজ বাদক, অভিনেতা। এ সবের পাশাপাশি চলত সাহিত্য চর্চাও। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আটপৌরে, স্নেহশীল, কর্তব্যপরায়ণ এক জন মানুষ। নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘কর্মজীবন বলে আমার কিছু নেই, অতি নিষ্কর্মা মানুষ আমি। নিজে হতে চেষ্টা ছিল না কখনও কিছু করবার, এখনও নেই। তবে খাটিয়ে নিলে খাটতে পারি, এই পর্যন্ত।’
ছেলেবেলায় দুষ্টুমির জন্য তাঁকে বাড়িতে ‘বোম্বেটে’ নাম দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় দোতলার বারান্দায় একটা জল ভর্তি টবে কিছু লাল মাছ থাকত। এক দিন তাঁর হঠাৎ মনে হল লাল মাছ তাই লাল জলে থাকা উচিত। অমনি লাল রঙ জোগাড় করে তাতে ঢেলে দিয়েছিলেন। পরে মাছগুলি সব মরে ভেসে উঠেছিল। আর এক বার বাড়িতে তখন পাখির খাঁচা তৈরি হচ্ছে। মিস্ত্রিরা দুপুরে টিফিন খেতে গিয়েছে এমন সময় তিনি হাতুড়ি, বাটালি নিয়ে কাঠের উপর যেমনি ঘা মেরেছেন, বাটালি বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে মাঝ দিয়ে চলে গেল। অমনি তিনি আঙুল চুষতে চুষতে দে ছুট। আসলে নানা কারণে অবন ঠাকুরের ছোটবেলাটা তাঁর সারা জীবনের উপর গভীর ভাবে একটা প্রভাব বিস্তার করেছিল।
একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অবনীন্দ্রনাথ। —ফাইল চিত্র।
ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও প্রথমে প্যাস্টেলে হাত পাকিয়ে তার পরে অয়েল পেন্টিং শিখেছিলেন সি এল পামারের কাছে। তার পরে জল রঙের কাজ শিখেছিলেন। প্রথম দেশীয় ধরনের ছবি ‘শুক্লাভিসার’ এঁকে তাঁর মন ভরেনি। তাই মনে মনে ঠিক করেছিলেন দেশীয় টেকনিক শেখার কথা। সেই সময় রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়িতে পবন নামের এক মিস্ত্রি ছবির ফ্রেমে সোনা লাগানোর কাজ করত। তাঁর কাছে গিয়ে ছবিতে সোনা লাগানোর পদ্ধতি শিখেছিলেন। এর পরই বৈষ্ণব পদাবলীর এক সেট ছবি এঁকেছিলেন। এর পরে একে একে এঁকে ছিলেন কৃষ্ণলীলা, আরব্য রজনী, শাহজাহানের মৃত্যু, ভারতমাতা ইত্যাদি কত না ছবি।
আরও পড়ুন: ভালবাসা জানে রবি ঠাকুর
অবনীন্দ্রনাথের জীবনে হ্যাভেল সাহেবের বড় প্রভাব ছিল। সেই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “ভাবি সেই বিদেশী-গুরু আমার হ্যাভেল সাহেব অমন করে আমায় যদি না বোঝাতেন ভারতশিল্পের গুণাগুণ, তবে কয়লা ছিলাম কয়লাই হয়তো থেকে যেতাম, মনের ময়লা ঘুচত না, চোখ ফুটত না দেশের শিল্প সৌন্দর্যের দিকে।”
শিক্ষক অবনীন্দ্রনাথকে নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনি। তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র নন্দলাল বসু উমার তপস্যা নামে একটি ছবি এঁকেছিলেন। ছবিটা দেখে অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ছাত্রকে জিজ্ঞেস করে ছিলেন ‘‘এত রং কম কেন? আর কিছু না কর উমাকে একটু চন্দন, ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে দাও।’’ ছবি হাতে নন্দলাল ফিরে গেলেন। তবে সারা রাত অবন ঠাকুরের ঘুম হল না। মনে মনে ভাবলেন কেন তিনি নন্দলালকে এমনটা বললেন। সে হয়তো উমাকে সেই ভাবে দেখেনি। তপস্যায় রত উমা কেনই বা ফুল-চন্দনে সাজবে? পর দিন ভোর হতেই তিনি ছুটলেন ছাত্রের ঘরে। দেখলেন রং তুলি হাতে নন্দলাল ছবিটিকে বদলানোর কথা ভাবছেন। তাঁকে আচমকাই থামিয়ে বললেন, ‘‘তোমার উমা ঠিকই আছে।...আর একটু হলেই ভাল ছবিখানা নষ্ট করে দিয়েছিলুম আর কী’’। শিক্ষক হিসেবে এমনটাই অবনীন্দ্রনাথ। নিজের ছাত্রের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করতে তাঁর এতটুকুও সংকোচ ছিল না।এক দিন সে কালের প্রখ্যাত শিল্পী রবি বর্মা জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি দেখতে। অবন ঠাকুর সেই সময় অবশ্য বাড়িতে ছিলেন না। কোনও একটা কাজে বাইরে বেরিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের ছবি দেখে রবি বর্মা খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন ‘ছবির দিকে এর ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল।’ তেমনই লর্ড কার্জন এক সময় অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি কিনতে চেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: সে কালের চিনে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন শান্তির কথা
তাঁর নিজস্ব শিল্পধারা ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয়। তার জীবদ্দশাতেই তাঁর শিল্পধারা দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। এক সময় কলকাতা প্লেগে আতঙ্কে ভুগছিল। চারদিকে মহামারির আকার ধারণ করেছিল। সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও বাড়ির সকলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথ ও সিস্টার নিবেদিতা বিভিন্ন পাড়ায় ইনস্পেকশনে যেতেন। কিন্তু সেই প্লেগ ঢুকল অবন ঠাকুরের নিজের ঘরে। ছিনিয়ে নিয়েছিল তাঁর ছোট্ট মেয়েটিকে। সেই শোক ভুলতে কিছু সময়ের জন্য জোড়াসাঁকো ছেড়ে তাঁরা চৌরঙ্গীর একটা বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। সেখানে বেশ কিছু পাখি পুষেছিলেন। সেই সময়ে এঁকে ছিলেন ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ সেই বিখ্যাত ছবিটি। অবনীন্দ্রনাথের কথায়, ‘মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম।’
পরিবারের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ।—ফাইল চিত্র।
ঠাকুরবাড়ির প্রথা অনুসারে জন্মাষ্টমীর দিনই প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালন করা হত কেননা জন্মাষ্টমীর দিনেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথের ইংরেজি জন্ম তারিখ ৭ অগস্ট। সেই উপলক্ষে এক বার রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতেই জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় শান্তিনিকেতনের কলাভবনের শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে অবনীন্দ্র জয়ন্তী পালন করেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের পৌত্র সুমিতেন্দ্রনাথের একটি লেখা থেকে জানা যায়, এতে উপস্থিত ছিলেন নন্দলাল বসু, গৌরী ভঞ্জ, রানি চন্দ, বিনায়ক মাসোজি প্রমুখ। ঠাকুরবাড়িতে বরাবরই জন্মাষ্টমীর দিনে অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করা হত। তবে তাঁর অন্যতম কৃতী ছাত্র মুকুলচন্দ্র দে প্রতি বছর ৭ অগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে জন্মদিন পালন করতেন। অথচ ১৯৪১-এর ৭ অগস্ট সব কিছু কেমন যেন বদলে গিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেই একটু একটু করে বদলে গিয়েছিল জোড়াসাঁকোর বাড়ির সমগ্র আবহাওয়াটা। জমিদারির আয় কমে যাওয়ায় মূলত অর্থনৈতিক কারণেই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে পরিবার এত দিন মিলেমিশে ছিল তা এবার পৃথক হয়েছিল। ১৯৪১-এ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবারকে। পরবর্তী ঠিকানা হল বরাহনগরের গুপ্ত নিবাস। এখানেই কেটেছিল তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলি।
তথ্য সূত্র
জোড়াসাঁকোর ধারে — অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রানী চন্দ— বিশ্বভারতী (বৈশাখ ১৪১৮)
ঘরোয়া— অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রানী চন্দ— বিশ্বভারতী (ভাদ্র ১৪১৭)
ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা— সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর— (ফাল্গুন ১৪১৪)