অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।
ভালবাসার তুমি কী জানো? কিচ্ছু জানো না। ভালবাসা জানে রবি ঠাকুর। ‘জানে’ দেখে অবাক হলে? ভাবছ ‘জানে’ নিত্য বর্তমান কালের ক্রিয়া। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছে সে তো অনেক বাইশে শ্রাবণ আগে, সুদূর অতীত কালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়ামাখা সেই সব দিন। পরাধীন ভারতের রাজনীতি-জটিল সেই সব দিন। বলা উচিত ছিল, যদি বলতেই হয়, ‘ভালবাসা জানত রবি ঠাকুর।’ তা না বলে একেবারে জানে! যেন পাশের বাড়ির ছেলেটি, এখনও এই কলকাতায় যেন তার নিত্য আসা যাওয়া! খুবই পরিচিত ভদ্রলোক তোমার! তুমি তার কাছে যেন ভালবাসার সহজ পাঠ নিচ্ছ! একেবারে আদিখ্যেতা! খানিকটা এমন আদিখ্যেতা, ‘ন হন্যতে’ উপন্যাসে রবি ঠাকুরকে ঘিরে, পড়েছিলাম বটে। তবে সেও তো অনেক কাল আগের লেখা নভেল। এই একুশ শতকে ফের! সব কিছুর একটা সীমা আছে!
আমি অবশ্য বলব, না সীমা নেই। কিছু দিন আগে আশিস নন্দীর সঙ্গে জয়ন্তী বসুর কথোপকথন বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, ফুটপাথ পেরোলেই সমুদ্র । পড়েছ কি না জানি না! আশিস নন্দী পাশ্চাত্যের ভালবাসা ও যৌনতার সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন সেখানে। বলেছেন পাশ্চাত্যে যৌনতা নিয়ে এত কথা, অথচ পশ্চিম ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায় ‘ওদের স্পার্ম কাউন্ট পড়ে যাচ্ছে।…বিয়েটাও এখন যৌনতাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। যৌনতার ধার কমে গেলেই বিয়েটা অর্থহীন হয়ে যায়।’ আশিস নন্দীর এই কথাগুলো খুব ভাবাচ্ছে আমাকে।
আরও পড়ুন: স্মরণের ফ্রেমে ২২শে শ্রাবণ
রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমল খুললাম । তিনটে ছোট ছোট কবিতায় চোখ আটকে গেল। ‘দেহের মিলন’, ‘শ্রান্তি’, ‘বন্দী’। ‘প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন’ এই ছিল প্রথম কবিতার মূল কথা। তাই কবিতার শেষে লিখেছিলেন, ‘দেহের রহস্য মাঝে হইব মগন।’ লিখেছিলেন, দেহমন চির রাত্রিদিন ‘তোমার সর্বাঙ্গে’ বিলীন হয়ে যাবে। একটু এগোতেই অবশ্য টের পাওয়া গেল ‘ডুবিতে ডুবিতে যেন সুখের সাগরে’ শ্বাসরুদ্ধ হয়। দেহ ভোগের সুখশ্রম শেষ কবিতায় আর সুখ রইল না মোটে। কাতর প্রার্থনা, ‘চুম্বনমদিরা আর করায়ো না পান’ ‘ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান।’ ভেবে দেখো যৌনতা তা প্রাণের মিলন বাসনার প্রকাশ হতে পারে কিন্তু ক্রমাগত যৌনতা ‘শ্বাস রুদ্ধ’ করে— মনে হয় ‘আমারে ঢেকেছে তব মুক্ত কেশপাশ,/তোমার মাঝারে আমি নাহি দেখি ত্রাণ।’ কেউ হয়তো ভাবতেই পারেন যৌনতাতেই যৌনতার ক্লান্তি অবসান হবে। এক জনের সঙ্গে সম্পর্কে যৌনতার ধার কমে গেলে আর একটা সম্পর্ক। প্রাতিষ্ঠানিক বিয়ের থেকে সহবাস ভাল। ইচ্ছেমতো সম্পর্ক থেকে যাওয়া যাবে সম্পর্কান্তরে, বিবাহবিচ্ছেদের ঝক্কি নেই। তবু পাশ্চাত্যে আশিস নন্দীর হিসেব মতো কমে যাচ্ছে স্পার্মের কাউন্ট – অতি ব্যবহারে যৌনতা হারাচ্ছে তার ধার। এ কথাটাই এক রকম করে উঠে এসেছিল কড়ি ও কোমলের কবিতাগুলিতে। কড়ি ও কোমল ১৮৮৬ সালে প্রকাশ পেয়েছিল। বন্ধু আশুতোষ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন এ কবিতাগুলোর সঙ্গে ফরাসি কোনও কোনও কবির ভাবের মিল আছে।
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।
আরও পড়ুন: যদি রবিঠাকুর থাকেন!
যৌনতার ক্লান্তি টের পেয়েছিলেন বলেই হয়তো রবীন্দ্রনাথের ভালবাসা কখনও ভালবাসার পাত্রকে গিলে খেতে চায় না। তাঁর ভালবাসার এটাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। ঘরে বাইরে উপন্যাসের কথা মনে করো। নিখিলেশ পুরুষ মানুষ, তায় জমিদার। স্ত্রী বিমলা বন্ধু সন্দীপে আচ্ছন্ন। নিখিলেশ তা জানতে-বুঝতে পারছে, কিন্তু বিমলার ওপর দাম্পত্যের দাবি ও অধিকার খাটাচ্ছে না। নিখিলেশের বন্ধু সন্দীপ বিমলাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ‘প্রবৃত্তিকে বাস্তব বলে স্বীকার করা ও শ্রদ্ধা করাই হচ্ছে মডার্ন্’। আর্টের নাম করে সন্দীপ বিমলার সঙ্গে ‘যে-সব ছবির যে-সব কথার আলোচনা করতে ভালোবাসে’ তা যৌনতাকে মুখ্য বলে মনে করে। এই যৌনতার সীমাবদ্ধতা বিমলা টের পেয়েছিল শেষ অবধি, তা টের পাওয়ানোর জন্য নিখিলেশকে জোর খাটাতে হয়নি। ঘরে বাইরে-র আগে ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্প লিখে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে মৃণাল নামের মেয়েটি তার স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যায়। মৃণালের স্বামী যে সেকালের কোনও কোনও পুরুষের মতো স্ত্রীকে নির্যাতন করেছে তা কিন্তু নয়। মৃণালের গৃহত্যাগের কারণ আরও সূক্ষ্ম– সে বুঝতে পারছে স্বামীগৃহে তার মতামতের কোনও মূল্য নেই। নিখিলেশ বিমলার ওপর জোর খাটায় না বলে সে সেকালের গড় পুরুষদের থেকে আলাদা, আর মৃণাল শুধু খাওয়া-পরার স্বাচ্ছন্দ্যে স্বামীগৃহে পোষ মেনে থাকে না বলে সেকালের সাধারণ মেয়েদের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। এই যে অন্যরকম নারী-পুরুষ যাদের মন উঠছে জেগে, যারা নিজেরা জোর খাটায় না– জোরের কাছে নতিস্বীকার করে না তাদের নিয়েই রবীন্দ্রনাথের ভালবাসার ভাবনা আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: সে কালের চিনে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন শান্তির কথা
আমার পরাণ যাহা চায় এই খুব চেনা গানটার কথাগুলো খেয়াল করেছ ভাল করে? প্রথম তিনটে লাইন শুনেই ভাবো আহা! পরের অংশেই কিন্তু আসল কথাটা বলা হয়েছে। তুমি যদি আর কাউকে ভালবাসো তা হলে যেতে পারো। আমি তোমাকে হৃদয় মাঝে পেয়েছি, তাই আর কিছু চাই না। তোমাকে ছাড়তে আমার খুবই দুঃখ হবে কিন্তু তুমি, তোমার ভালবাসাই যে বড়। সে ভালবাসার টানে তুমি গেলে আমার জন্য রইল দীর্ঘ বিরহ। এ-ও তো সেই ছেড়ে দেওয়ার গান – ভালবেসে গভীর বিরহে ডুবে যাওয়ার গান। এই বিরহ বেদনাময়, ক্লান্তিকর কিন্তু নয়।
আজকাল খুব মনে হয় এই কথাগুলো। অ্যাসিডে পুড়িয়ে দেওয়া মেয়েদের মুখের খবর ছাপে কাগজ। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত যে তার পৌরুষ অ্যাসিড বাল্বে ঝলসে ওঠে। গোলকায়নের ফলে এখন নারী-পুরুষের যৌন আকর্ষণ বৃদ্ধির কত কলকব্জা। দেখতে দেখতে মনে হয় এ সবের বাইরে গিয়ে এক বার রবিঠাকুরের কাছে গিয়ে বসি। অনেক বাইশে শ্রাবণ আগে চলে গেছেন তিনি। তবে তিনি ভালবাসা জানেন।
ভালবাসা জানে রবি ঠাকুর।