Durga Puja

রবীন্দ্রনারায়ণের স্মৃতিতে ‘দেবী’র বিসর্জন

চোখ বুজলে দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পান রবীন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। ওঁর বয়স তখন ১৫-১৬। মুর্শিদাবাদের নিমতিতা জমিদারবাড়ির সঙ্গে সত্যজিতের সম্পর্কটা তত দিনে খুবই নিবিড়।

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৩১
Share:

—প্রতীকী ছবি।

মাঘের পড়ন্ত বেলা। চৌধুরীবাড়ির গোবিন্দ মন্দিরের পুব দিকের বারান্দায় কিন্তু অকাল শারদোৎসব। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাস। স্থানীয় প্রতিমাশিল্পীরা হাত চালিয়ে ঠাকুর গড়তে ব্যস্ত। সরস্বতী নয়, দুর্গা। ফেব্রুয়ারি মাসে শুটিং আছে যে! সত্যজিৎ রায় আসছেন! হাতে সময় বেশি নেই। ব্লোয়ার দিয়ে জলদি শুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে মাটি।

Advertisement

চোখ বুজলে দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পান রবীন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। ওঁর বয়স তখন ১৫-১৬। মুর্শিদাবাদের নিমতিতা জমিদারবাড়ির সঙ্গে সত্যজিতের সম্পর্কটা তত দিনে খুবই নিবিড়। অল্প দিন আগে ‘জলসাঘর’-এর শুটিং হয়ে গিয়েছে এই বাড়িতেই। এ বার ওঁরা আসছেন ‘দেবী’র আউটডোর শুটিংয়ে। ছবিতে একটা ভাসানের দৃশ্য থাকবে। তাতে একাধিক প্রতিমা লাগবে। সত্যজিতের চিঠি পেয়ে স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে প্রতিমা গড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছেন বাড়ির গুরুজনেরা। গুরুজন বলতে রবীন্দ্রনারায়ণের বাবা-জ্যাঠা-বড় ঠাকুরদা। ঠাকুরদারা দুই ভাই— জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ আর মহেন্দ্রনারায়ণ। মহেন্দ্র অকালে প্রয়াত আগেই। রবীন্দ্রনারায়ণ হলেন মহেন্দ্রর কনিষ্ঠ পুত্র রাধানাথের ছোট ছেলে।

জ্ঞানেন্দ্র-মহেন্দ্রর পূর্বপুরুষেরা সেই লর্ড কর্নওয়ালিসের আমল থেকে নিমতিতার জমিদার। এই বাড়িটা ১৮৬৫ সালে তৈরি। চৌধুরীরা আদতে পাবনার লোক। হোসেন শাহি আমলে গৌড়ে এসে সুলতানের দরবারে চাকরি নিয়েছিলেন। সুলতানি আমল পার হওয়ার পরে ওঁরা চলে যান রঘুনাথপুরে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে জমিদারি স্বত্ব পাওয়ার পরে নিমতিতায় ওঁদের বসবাস শুরু হল।

Advertisement

নিমতিতার সঙ্গে সত্যজিতের যোগাযোগ ‘জলসাঘর’-এর সময় থেকে। সত্যজিৎ আর বংশী চন্দ্রগুপ্ত মিলে তখন হন্যে হয়ে জমিদারবাড়ি খুঁজে চলেছেন। সত্যজিতের সহকারী নিত্যানন্দ দত্ত আর সুবীর হাজরার পরিচিত ছিলেন রবীন্দ্রনারায়ণের পিসতুতো দাদা উদয়শঙ্কর রায়। ওঁর কাছে নিমতিতার বাড়িটার একটা ছোট্ট ছবি ছিল। সেটা উনি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু ছবিতে ভাল বোঝা যায়নি। তার পরে লালগোলায় একটা জমিদারবাড়ি দেখতে এসে স্থানীয়দের মুখে নিমতিতার কথা শোনেন সত্যজিৎ। নিমতিতার বাড়ি দেখতে আসার সিদ্ধান্ত তখনই।

রবীন্দ্রনারায়ণের স্মৃতি বলছে, ‘‘আমি সে দিন স্কুলে ছিলাম। ক্লাসঘরের জানলা থেকে দেখি, একটা কালো গাড়ি ধুলো উড়িয়ে আমাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সেটা ভোটের বছর (১৯৫৭)। দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন সামনেই। মালদহ থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী রেণুকা রায় তখন প্রায়ই আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। আমি ভেবেছি, তারই কোনও গাড়ি। বাড়ি ফিরে শুনি, সত্যজিৎ রায়। দেখতে পেলাম না বলে মন খারাপ হল। তবে বড়রা বললেন, বাড়ি পছন্দ হয়েছে। উনি শীঘ্রই আবার আসবেন।’’ সত্যিই এলেন। এ বার সঙ্গে সুব্রত মিত্র। রাতের নিমতিতা সে দিন ভেসে গেল সুব্রতের সেতারের মূর্ছনায়।

‘জলসাঘর’-এর লম্বা শুটিং পার হল। সবাই খুব খুশি। সত্যজিৎ কিন্তু নিমতিতাকে ভোলেননি। ১৯৫৯-এর শীতে চিঠি লিখে জানালেন, ‘দেবী’র আউটডোর নিমতিতাতেই করতে চান। লাইন করে লোক আসছে দেবীদর্শনে, সেই ছবি তোলা হবে জমিদারবাড়ির ছাদ থেকে। আর তোলা হবে, নদীর ধারে দয়াময়ী আর উমাপ্রসাদের দু’টো বড় দৃশ্য। তার সঙ্গে আছে, ভাসান। ‘দেবী’তে দুর্গাপ্রতিমার খুব বড় ভূমিকা রয়েছে। ছবিতে যে মূল প্রতিমাটি দেখা যায়, সেটা বানানো হয়েছিল কৃষ্ণনগরের প্রতিমাশিল্পীকে দিয়ে।

রবীন্দ্রনারায়ণের মনে আছে, ট্রাকে করে সেই প্রতিমা এল। পাছে ঝাঁকুনিতে ক্ষতি হয়, প্রতিমার বিভিন্ন অংশ আলাদা করে রাখা হয়েছিল। শিল্পীও সঙ্গে এলেন। নিমতিতায় বসেই পূর্ণাঙ্গ প্রতিমা সাকার হল। ভাসানের মিছিলে সেই প্রতিমার সঙ্গী হল নিমতিতায় তৈরি ছোট দু’টি প্রতিমা। ভাসানের মিছিল যাতে বাস্তবানুগ হয়, তার জন্য রাধানাথ এলাকায় ঢোলাই দিয়ে আগাম ঘোষণা করে রাখলেন। প্রতিমা নিরঞ্জনের দিন নদীর ধারে এমনিতে যেমন মেলা বসত, ঠিক তেমনই তেলেভাজা-বেলুনের দোকান সহযোগে অকাল ভাসান-মেলা বসে গেল। সেই মেলার ভিড়কেই দেবীর ভাসান দৃশ্যে মশাল নিয়ে দেখা যায়। এই প্রতিমাই আবার পাড়ি দেবে কলকাতা। টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োয় ইনডোর সেট পড়ছে। নিমতিতার দুর্গামণ্ডপের স্কেচ করে নিয়েছেন বংশী। নিমতিতার পুজোমণ্ডপই উঠে আসবে স্টুডিয়োয়।

চৌধুরীবাড়িতে দুর্গাপুজো হত বরাবরই। চক মেলানো উঠোন পেরিয়েই ছিল দুর্গামন্দির। দোতলা সমান উঁচু। কিন্তু দেউড়ি তো অত উঁচু নয়। তাই ঠাকুর গড়ার সময়ে দেউড়ির মাপে প্রতিমা তৈরি হত। মাথার পিছনে উঁচু করে চালা লাগিয়ে দেওয়া হত পরে, মন্দিরে অধিষ্ঠানের পর। বিসর্জনের সময়ে চালা খুলে ঠাকুর বাইরে এনে আবার পরিয়ে দেওয়া হত সেটা। কৃষ্ণনগরের যে শিল্পী সত্যজিতের জন্য প্রতিমা গড়েছিলেন, তাঁরা অনেক বার নিমতিতার বাড়ির পুজোতেও প্রতিমা গড়েছেন। আর স্থানীয় শিল্পীরা তো ছিলেনই। নিমতিতার সেই পুজো আজও বজায় আছে। রবীন্দ্রনারায়ণ এ বারেও পুজোয় সেখানেই যাবেন।

তবে নিমতিতার পুজো আর সত্যজিতের শুটিংয়ের গল্পে সমাপ্তি এখনও বাকি। ‘দেবী’তে নিমতিতা অকাল পুজোর স্বাদ পেয়েছিল। ‘সমাপ্তি’তে যেন ঠিক তার উল্টো। ১৯৬০-এর সেপ্টেম্বর। পুজোর প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে, চলছে শুটিংও। তিন কন্যার তৃতীয় কন্যা আর ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রের কিছু অংশের কাজ হচ্ছে একসঙ্গে। প্রবল বৃষ্টি আর কর্দমাক্ত রাস্তাই শুটিংয়ে প্রয়োজন। অমূল্য আর মৃন্ময়ী তো গল্পের স্বার্থেই আছাড় খাবে। তাদের ছবি তুলতে গিয়ে শুটিং টিমও পপাত চ। সৌম্যেন্দু রায় আছাড় খেলে ক্যামেরা ধরছেন পূর্ণেন্দু বসু, পূর্ণেন্দু আছাড় খেলে সত্যজিৎ নিজে। সত্যজিৎও আছাড় খাচ্ছেন বইকি! কুছ পরোয়া নেই, কাজের নেশায় বুঁদ সকলে। ইউনিটের সঙ্গে আছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। ফিরে গিয়ে ‘গ্রামবাংলার ডায়েরি’তে লিখবেন, ‘‘নিমতিতা। তেতো কে বলল? মিষ্টি।’’

শুটিং শেষ হতে হতে পুজো এসে গেল। ‘লাইফ’ পত্রিকার ফটোগ্রাফার ব্রায়ান ব্রেক ষষ্ঠীর দিন নিমতিতার পুজোর ছবিও তুলে রাখলেন। সপ্তমীর সন্ধেয় ইউনিট কলকাতা ফেরার জন্য রওনা দেবে। রবীন্দ্রনারায়ণের মনটা ভরা-পুজোর মধ্যেও ভার। উৎসবে যেন অকাল বিষাদের বাঁশি। সপ্তমীর সন্ধ্যারতি হচ্ছে ঠিকই, মনের মধ্যে বিসর্জনের বাদ্যি। খালি খালি লাগছে! হ্যাজাকের আলো তাকিয়ে দেখছে, তোয়ালে-সাবান হাতে নিয়ে স্নান করতে যাচ্ছেন সত্যজিৎ, আপন

মনে গাইছেন ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে...।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement