অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি অ্যাসোসিয়েশনের বিক্ষোভ। ছবি: পিটিআই।
জুনে ১৩৯৪ ইউনিট খরচ দেখিয়ে সিইএসি ১২,৩১০ টাকার বিল ধরিয়েছিল শোভাবাজারের বাসিন্দা এক গ্রাহককে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে সংস্থায় ফোন করে অভিযোগ জানানোর পরে, তড়িঘড়ি দেওয়া হয় সংশোধিত বিল। বিস্ময়ের মাত্রা কার্যত আকাশ ছোঁয়, যখন নতুন বিলের অঙ্কটা দেখা যায় ৩২৭০ টাকা। ইউনিট খরচ ৪৩২। সংস্থার তরফে ওই গ্রাহককে বলা হয়েছিল, ‘‘বুঝতেই পারছেন, খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে কিছু ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে।’’ বিলের অঙ্ক কমলেও ওই গ্রাহকের প্রশ্ন, সিইএসসি বার বার বলছে, আনলক পর্বে মিটার রিডিং নেওয়ার পরেই পাঠানো হচ্ছে জুনের বিল। যেখানে এপ্রিল-মে মাসে বিদ্যুৎ খরচের অনাদায়ী ইউনিটের দামও ধরা আছে। অথচ গত মাস চারেক সংস্থাটির কেউ মিটার রিডিং নিতে আসেননি। তা হলে ওই বিল তৈরি হল কী করে? শুধু তাই নয়, মূল বিল আর সংশোধিত বিলের এমন ফারাকই বা হওয়ার কারণ কী? প্রথম বিলের সঙ্গে আগের বছর একই সময়ের বিলের ফারাকও স্পষ্ট। ওই গ্রাহকের সন্দেহ, তা হলে কি বেশি ইউনিট দেখিয়েই সিইএসসি উঁচু মাসুলের স্ল্যাবে ফেলে বিল বাড়িয়ে নিচ্ছে? যদিও সংস্থা প্রথম থেকে বারবারই দাবি করে আসছে, স্ল্যাবের সুবিধা পাচ্ছেন সবাই।
এমন সব প্রশ্ন কলকাতা ও শহরতলির কিছু অংশে বহু গ্রাহকেরই। তাঁদের কেউ হয়তো সংশোধিত বিল পেয়েছেন। কেউ পাননি। তার উপরে রবিবার রাতে সিইএসসি জানিয়েছিল, গৃহস্থ গ্রাহকের এপ্রিল-মে মাসের বাড়তি ইউনিটের বিল আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। কী ভাবে তা কার্যকর করা হবে আলোচনা চলছে। ফলে গ্রাহককে এখন শুধু জুনের টাকা দিলেই চলবে। তবে তা মেটানোর শেষ দিনও পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাঙ্কের ইসিএস মারফত বিল মেটান এমন কিছু গ্রাহকের দাবি, আশ্চর্যজনক ভাবে এই ঘোষণার দিন, অর্থাৎ রবিবার রাতেই ব্যাঙ্ক থেকে তাঁদের সিইএসসি-র বিদ্যুৎ বিলের টাকা কাটা হয়েছে। যদিও সোমবার সংস্থাটির কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পরে গ্রাহকদের উদ্দেশে বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের বার্তা, ‘‘জুনের নতুন বিল পাওয়ার পরে তা মেটানোই ভাল। কারণ, স্বাভাবিক নিয়মেই টাকা অনেকটা কমবে।’’
যাঁদের বিল ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে, তাঁদের কী হবে কিংবা নতুন করে সিইএসসি বিল পাঠাবে কি না, তার হিসেব কষা হবে কী ভাবে, এই সমস্ত প্রশ্নের জবাবে সংস্থার দাবি, আলোচনা চলছে। বিষয়গুলি চূড়ান্ত হলে গ্রাহকদের মেল করে, ফোনে বা এসএমএসে জানিয়ে দেওয়া হবে। এই সব কারণেই বিল জমার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু রাজ্যে, সপ্তাহে দু’দিন পূর্ণ লকডাউন
তবে এ সবের উত্তর খুঁজতেই সোমবার বিদ্যুৎমন্ত্রী সংস্থার কর্তাদের ফারাক আলোচনায় ডেকেছিলেন। পরে মন্ত্রীর দাবি, অনেক জবাব মেলেনি। সব কিছু স্পষ্ট করে জানাতে সিইএসসি কয়েক দিন সময় নিয়েছে। যদিও একই সঙ্গে শোভনদেববাবু জানান, সংস্থার কর্তারা তাঁকে বলেছেন, জুনের জন্য নতুন করে বিল তৈরি করা হবে। তাতে ‘লেট ফাইন’ নেওয়া হবে না। গ্রাহকেরা বিলের উপর ছাড় পাবেন। বিল দেরিতে দিলে কোনও বাড়ির লাইনও কাটা হবে না। তাঁর বক্তব্য, নতুন করে বিল তৈরি ও তা জমার পুরো কাজটা করতে গেলে সিইএসসি-কেও নতুন ব্যবস্থা করতে হবে। যে কারণে তারা সময় চেয়েছে।
অস্বাভাবিক চড়া বিলের অসহায়তা গ্রাস করার পরে ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন গ্রাহকদের একাংশ। বিক্ষোভে ফের উত্তাল সোশ্যাল মিডিয়া। কারও ক্ষেত্রে শ’খানেকের বিল পৌঁছেছে ৮-১০ হাজারে। ৪-৫ হাজার টাকা দিতে অভ্যস্ত কোনও গ্রাহকের নাভিশ্বাস উঠেছে পাঁচ-ছ’গুণ ফুলেফেঁপে ওঠা টাকার অঙ্ক দেখে। গ্রাহকেরা তড়িঘড়ি হাতড়াতে শুরু করেছেন আগের বছরের একই সময়ের বিলগুলি। তাঁদের তোপ, ‘‘লকডাউনে মানুষ ঘরবন্দি থাকায় বিদ্যুতের খরচ হয়তো কিছুটা বেশি হয়েছে। তবে গরমের দোহাই দিয়ে যাতে চোখ কপালে তোলার মতো এত বেশি খরচের যুক্তি খাড়া না-করতে পারে সংস্থা, তাই সেই ফারাকটা তাঁরা কষে রাখছেন। অভিযোগ জানাতে কাজে লাগবে।’’
বিল নিয়ে এ দিন সিইএসসি-র ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে বিক্ষোভ দেখায় রাজ্যের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংগঠন অ্যাবেকা-সহ আরও কয়েকটি সংগঠন। বিল মকুবেরও দাবি তোলে তারা। অ্যাবেকার সাধারণ সম্পাদক প্রদ্যুৎ চৌধুরীর কথায়, ‘‘সিইএসসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। বিল নিয়ে গ্রাহকদের যে অসংখ্য প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে, তার স্পষ্ট জবাব মেলেনি। শুধু বলা হয়েছে, কাজ চলছে।’’ তিনি জানান, ২৪ জুলাই অ্যাবেকার পক্ষ থেকে রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ দিবস ডাকা হয়েছে।
সিইএসসি অবশ্য প্রথম থেকেই দাবি করে আসছে, বিল নিয়ে কোনও বিভ্রান্তি থাকলে তা গ্রাহকেরা অভিযোগ জানাতে পারেন। তারা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। কোনও ভুল থাকলে তা সংশোধনও করা হচ্ছে। তবে অধিকাংশ গ্রাহকেরই দাবি, সংস্থার হিসেব ও ব্যাখ্যায় তাঁরা সন্তুষ্ট নন। সিইএসসি-র পক্ষ থেকে এ কথাও প্রথম দিন থেকে দাবি করা হয়েছে, স্ল্যাবের সুবিধা সব গ্রাহক পাচ্ছেন। উঁচু স্ল্যাবে ফেলে বিল বাড়ানো হচ্ছে না। মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, প্রভিশনাল বিল (লকডাউনের সময় আগের ছ’মাসের বিদ্যুৎ খরচের গড় করে তৈরি বিল) অনেক কম ছিল।
গ্রাহকদের ক্ষোভ, বিল নিয়ে বিভ্রান্তি অগুনতি। ফলে বিল স্থগিত রাখা বা এখন না নেওয়া তার সমাধান হতে পারে না। ভুল ঠিক না-করে, সেটা স্পষ্ট জানাতে হবে।
সিইএসসি-র বিদ্যুৎ বিল নিয়ে ২০১৫ সালে বিক্ষোভ শুরু করেছিল ইয়ং বেঙ্গল নামে কলকাতারই একটি সংগঠন। তাদের সভাপতি প্রসেনজিৎ বসুর বক্তব্য, বিল নিয়ে সংস্থা যা পদক্ষেপ করেছে, তা সমস্যার সুরাহার বদলে আরও বেশি বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এপ্রিল-মে ও মে-জুন মাসের বিল বাতিলের দাবি তুলেছেন তাঁরা। সংগঠনের বক্তব্য, এই সময়ের জন্য নতুন বিল গ্রাহকদের পাঠাতে হবে। যেখানে স্বচ্ছ ভাবে সব হিসেব পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে হবে।