— প্রতীকী চিত্র।
১৮ বছরের কম বয়সি প্রসূতিদের মধ্যে ১৮ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্ক প্রসূতিদের মধ্যে ১২ শতাংশ কিডনি বিকল হয়ে মারা যাচ্ছেন। সুস্থ মা সুস্থ সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন, কিন্তু তার পরেই আচমকা একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যু হচ্ছে তাঁর। শুধু মেদিনীপুর মেডিক্যালে নয়, অন্যত্রও। কেন এমন হচ্ছে, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ হওয়া অক্সিটোসিনকেই অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন সরকারি স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। গত মাসে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলার জন্য রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমের কাছে সময় চেয়েছিলেন তাঁরা। অভিযোগ, তাঁদের সময় দেওয়া হয়নি।
সোমবার তদন্ত কমিটি স্যালাইনের পাশাপাশি অক্সিটোসিনকেও দায়ী করায় তাঁদের অভিযোগ, “অনিচ্ছাকৃত নয়, প্রত্যেকটি মৃত্যুকে আমরা তো তা হলে ইচ্ছাকৃতই বলব। এই অবহেলা তো ইচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোরই নামান্তর।” কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের এক প্রবীণ স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকও বলেন, “গর্ভাবস্থা বা প্রসব কোনও অসুখ নয়। ন’মাস যে মা সুস্থ থাকলেন, সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে তাঁর হঠাৎই মুমূর্ষু হয়ে পড়ার পিছনে অনেক বড় অনিয়ম, বড় অবহেলা দায়ী।”
স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম অবশ্য বলেন, “মাতৃমৃত্যু আমাদের কাছে সব সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা নিয়মিত এ নিয়ে বৈঠক করি। কোন ডাক্তারেরা কবে কথা বলতে চেয়েছেন, সেটা আমার পক্ষে মনে রাখা সম্ভব নয়। দরকার হলে ওঁরা স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তাবা স্বাস্থ্য অধিকর্তার সঙ্গে কথা বলে নিতে পারেন।”
এ দিন রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, সরবরাহ হওয়া অক্সিটোসিন নিয়ে বার বার সমস্যা হওয়ায় এখন একাধিক হাসপাতাল তা ব্যবহার করে না। রোগীর পরিবারকে বাইরের দোকান থেকে অন্য সংস্থার অক্সিটোসিন নিয়ে আসতে বলা হয়। এর মধ্যে জেলার একাধিক হাসপাতালের পাশাপাশি রয়েছে কলকাতার দু’টি নামী মেডিক্যাল কলেজও।
প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ ঠেকাতে অক্সিটোসিন অত্যন্ত জরুরি ওষুধ। সিজ়ারের ক্ষেত্রে সমস্ত প্রসূতিকে স্যালাইনে মিশিয়ে শিরায় অক্সিটোসিন দেওয়া হয়। স্বাভাবিক প্রসবে পেশিতে দেওয়া হয়। চিকিৎসকদেরএকাংশের বক্তব্য, “অক্সিটোসিনের মান ঠিক না থাকলে লোহিত কণিকা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, হিমোগ্লোবিন কমতে পারে, বিলিরুবিন বাড়তে পারে। কিডনি নেক্রোসিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে।” সরকারি স্ত্রী রোগ চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, কর্নাটকের যে সংস্থা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে একচেটিয়া ভাবে অক্সিটোসিন সরবরাহ করে, তাদের মান নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেন্দ্র অক্সিটোসিনউৎপাদনের জন্য ওই সংস্থাকেই চিহ্নিত করলেও তাদের মান নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রশ্ন ওঠায়, ২০১৯ সালে দিল্লি হাই কোর্ট রায় দেয়, অন্য সংস্থাও অক্সিটোসিন তৈরি করতে পারবে। তার পর থেকেই একাধিক রাজ্য অন্য সংস্থা থেকে অক্সিটোসিন কিনতে শুরু করে। সেই সব রাজ্যে প্রসূতি মৃত্যুর হার যথেষ্ট কম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সেই পথ অনুসরণকরেনি। কেন?
সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্সের ডেপুটি ডিরেক্টর প্রশান্ত বিশ্বাস বলেন, “জানতামই না এমন কোনও রায়ের কথা। আমাদের কাছে উপর থেকে যা নির্দেশ আসে, আমরা সেটাই করি।”
বেসরকারি হাসপাতালের স্ত্রী রোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অক্সিটোসিন সংরক্ষণ করার জন্য যে ‘কোল্ড চেন’ বজায় রাখতে হয়, তা বহু ক্ষেত্রেই হয় না। তাতে অক্সিটোসিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।নষ্ট হয়ে যাওয়া অক্সিটোসিন ব্যবহারের পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। তাই অনেক জায়গায় এখন প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ ঠেকাতে কার্বেটোসিন ব্যবহার করা হয়। সরকারি স্তরে এ নিয়ে অবিলম্বেভাবা দরকার।”
কেন কার্বেটোসিন নিয়ে ভাবা হয়নি? ডাক্তারদের বক্তব্য, “ভাবার জন্য তো কর্তাদের আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁদের সেই সময় কই?” আর প্রশান্তের জবাব, “বিশেষজ্ঞ কমিটি এখনও কিছু জানায়নি। তাই আমাদের কিছুই করার নেই।”