আবার একটি ট্রেন দুর্ঘটনা: ঝাড়খণ্ডে দুর্ঘটনার পর হাওড়া-মুম্বই মেল। ছবি: পিটিআই।
একে দেরিতে রক্ষা নেই, দুর্ঘটনা দোসর!
দক্ষিণ-পূর্ব রেলে যাত্রী পরিষেবার মান এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যাত্রীদের কাছে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। অভিযোগ, হাওড়া থেকে কোনও ট্রেনই সময়ে ছাড়ে না। তা সে লোকাল হোক বা দূরপাল্লার। ছাড়লেও সেই ট্রেন কখন গন্তব্যে পৌঁছবে তারও ঠিক থাকে না। প্রতি দিনই কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়, অমুক এক্সপ্রেস আজ দেরিতে ছাড়বে। তমুক লোকাল আজ বাতিল আছে। সেই দেরির পরিমাপ কখনও কখনও পাঁচ-ছ’ঘণ্টাও হয়ে যায়। তার মধ্যে যেমন নামী মেল-এক্সপ্রেস রয়েছে, রয়েছে শতাব্দী, জন শতাব্দীর মতো ট্রেনও। লোকাল ট্রেনের কথা ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। আপ হোক বা ডাউন, দেরিতে চলছে না, এমন লোকাল ট্রেন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বেশ কয়েক মাস ধরে হাওড়ায় দক্ষিণ-পূর্ব রেলের পরিষেবার হাল এমনটাই। অগত্যা যাত্রীরা দেরির ট্রেন পরিষেবাতেই চালিয়ে নিচ্ছিলেন। এক প্রকার অনন্যোপায় হয়েই।
এ তো গেল দেরির কথা। এর সঙ্গে ইদানীং যাত্রীদের মনে দুর্ঘটনার ভয়ও ঢুকে পড়েছে। কারণ, দক্ষিণ-পূর্ব রেলে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছে। অতীতে যা হয়েছে সেই পরিসংখ্যানের সালতামামিতে না গিয়েও অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন গত বছরের জুন মাসে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কথা। ২৯৬ জন যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। আহত বহু। সেই ট্রেনও ছিল দক্ষিণ-পূর্ব রেলের। মঙ্গলবার যে হাওড়া-মুম্বই মেল দুর্ঘটনার কবলে পড়ল, সেই ট্রেনও দক্ষিণ-পূর্ব রেলই চালায়। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দু’জনের মৃত্যুর কথা জানা গিয়েছে। আহত অনেকে।
মঙ্গলবার দুপুরে হাওড়া থেকে দিঘা যাওয়ার ট্রেন কান্ডারি এক্সপ্রেস ধরতে এসেছিলেন বসিরহাটের বাসিন্দা দেবমাল্য লাহিড়ি। বলছিলেন, ‘‘কাজের সূত্রে আমাকে নিয়মিত দিঘা যেতে হয়। ইদানীং প্রায় প্রতি দিনই প্রচুর লেট করে চলছে ট্রেন। আজও তাই।’’ পেশায় ব্যবসায়ী দেবমাল্য আরও বললেন, ‘‘আজকাল ট্রেনে চড়তে ভয় করে। এই তো সে দিন আগরতলা থেকে আসা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস নিউ জলপাইগুড়ির কাছে দুর্ঘটনার কবলে পড়ল। ১০ জন মারা গেলেন। গোন্ডায় ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় দু’জন মারা গেলেন। আজ মারা গেলেন দু’জন। ভেবেই আতঙ্ক হয় আজকাল।’’
বস্তুত, দক্ষিণ-পূর্ব রেলে সফর যেন যাত্রীদের কাছে সাক্ষাৎ আতঙ্কের। মেদিনীপুরের বাসিন্দা শ্যামল গুঁই চিকিৎসার কারণে বেঙ্গালুরু যাবেন। মঙ্গলবার রাতে ট্রেন। টিকিট কনফার্ম হয়নি। কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘‘কেন্দ্রে নতুন সরকার গঠনের পর এই নিয়ে তিনটি বড় ট্রেন দুর্ঘটনা হল। খবরে জানলাম, গত ১৩ দিনে ছোটবড় মিলিয়ে ১৩টি ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছে। ট্রেনে উঠতেই তো ভয় লাগছে।’’ যাত্রীরা যখন ‘ভয়’ পাচ্ছেন, রেল কর্তৃপক্ষ তখন মুখে কুলুপ এঁটে ‘সোজাসাপটা’ বিবৃতি দিচ্ছেন, ‘‘তদন্ত শেষ না হওয়ার আগে কিছু বলা যাবে না।’’ কিন্তু বার বার এই দুর্ঘটনা এবং পরিষেবা বিকলের দায় কি এ ভাবে এড়ানো যায়? হাওড়া-মুম্বই মেল দুর্ঘটনার পর সেই প্রশ্নই উঠছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে যাত্রীসুরক্ষা নিয়েও। কেন এত সমস্যা? কেন বার বার সমালোচনার মুখে পড়েও উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে দেখা যাচ্ছে না দক্ষিণ-পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষকে? সমস্যা কোথায়? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
তথ্য বলছে, এই প্রথম বা দ্বিতীয় নয়। বহু দিন ধরেই দক্ষিণ-পূর্ব রেলের বিভিন্ন শাখায় যাত্রী পরিষেবা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠছে। সুবীর সরকার নামে এক প্রৌঢ়ের কথায়, ‘‘চিকিৎসার জন্য মাঝেমধ্যে চেন্নাই যেতে হয়। কিন্তু, ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়ে না। কৃষ্ণনগর থেকে রাতে ট্রেন ধরতে চলে আসতে হয় হাওড়া স্টেশনে। সকালে কখন ট্রেন ছাড়বে তারই তো ঠিক থাকে না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘স্টেশনে ভাল একটা বিশ্রামাগার নেই। অথচ, টাকা তো কম নিচ্ছে না রেল!’’
বিভিন্ন লোকাল ট্রেনের যাত্রীরা সাফ জানাচ্ছেন, পরিষেবা বলে আর কিছু নেই দক্ষিণ-পূর্ব রেলে। পবিত্র সাউ নামে লোকাল ট্রেনের এক যাত্রীর কথায়, ‘‘দক্ষিণ-পূর্ব রেলে ট্রেন এত দেরিতে চলে যে, আগে বেরিয়েও অনেকে ঠিক সময়ে অফিস পৌঁছতে পারি না। সময় মতো অফিস যেতে না পেরে চাকরি খুইয়েছেন এমন সহযাত্রীকেও আমি চিনি। আর দেরিতে অফিস ঢোকার জন্য মাইনে থেকে টাকা কেটে নেওয়ার কথা না-ই বললাম।’’ কটাক্ষ করে কলকাতার একটি অফিসে কাজ করা পবিত্র আরও বলেন, ‘‘এখন তো লোকালে ট্রেনে চড়লে মনে হয়, আজই চাকরি গেল। বার বার সমস্যার কথা আধিকারিকদের জানিয়েও লাভ হয়নি।’’
লোকাল ট্রেন পরিষেবা নিয়ে রেলের প্রতিশ্রুতি। —নিজস্ব চিত্র।
হাওড়া স্টেশনে যাত্রীবিক্ষোভ, টিকিয়াপাড়া, রামরাজাতলার মতো স্টেশনে রেল অবরোধ হলেও কর্তৃপক্ষের হেলদোল নেই বলেই যাত্রীদের অভিযোগ। চাপে পড়ে সোমবার লিখিত ভাবে যাত্রীদের কাছে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে অবরোধ তুলতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। এ নিয়ে সরাসরি কোনও বিবৃতিই দিতে চাইছে না রেল। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এক আধিকারিক আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে যে কথা বললেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘‘দক্ষ কাজের লোক কমে গিয়েছে। তার উপর আউটসোর্সিং। সব মিলিয়ে ফল— পরিষেবা ভেঙে পড়েছে।’’ আর দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ওমপ্রকাশ চরণ সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন, ‘‘এই শাখায় ট্রেনের প্রচুর চাপ।’’
মঙ্গলবার ঝাড়খণ্ডে হাওড়া-মুম্বই মেলের দুর্ঘটনা নিয়ে মোদী সরকারকে বিঁধেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রের এনডিএ সরকারকে তোপ দেগে মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতার প্রশ্ন, “এটাই কি সরকার চালানোর নমুনা?” রেলকে নিয়ে সরকারি উদাসীনতা থামবে কবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন এনডিএ এবং ইউপিএ আমলে রেলমন্ত্রী থাকা মমতা।
দক্ষিণ-পূর্ব শাখায় ধারাবাহিক ভাবে গন্ডগোল কেন? মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ওমপ্রকাশ বলেন, ‘‘হাওড়া স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম কম। তাই পর পর ট্রেনের যেতে-আসতে সমস্যা হয়।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘তবে চেষ্টা করা হচ্ছে সমস্যা সমাধানের। হাওড়ার বদলে সাঁতরাগাছি এবং শালিমার স্টেশন থেকে বেশি করে ট্রেন দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। থার্ড লাইনেরও কাজ চলছে। আগামী দিনে পরিষেবা স্বাভাবিক রাখার সব রকম চেষ্টা করা হচ্ছে।’’