ফাইল চিত্র।
চার বছর আগে সিঙ্গুরের এক চাষির দুর্দশা নিয়ে ফের চর্চা শুরু হয়েছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
নীতি আয়োগের বৈঠকে চাষের কাজে গোবর, গোমূত্র, গুড়, পিঁপড়ের বাসা আর ডালের গুঁড়ো ব্যবহারের কথা উঠেছে। তাতেই অবাক ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-বিজ্ঞানীরা। তাঁরা মনে করছেন, এতে হিতে-বিপরীত হবে। কারণ হিসেবে তাঁরা সিঙ্গুরের ওই চাষির দুর্দশার কথা তুলছেন।
সম্পন্ন ওই চাষি পরিচিতের পরামর্শ মতো রাসায়নিক সারকে বিদায় দিয়ে পুরোপুরি গোবর সার দিয়ে চাষ শুরু করেছিলেন। প্রথম বছরে ভালই ফসল ফলে। বিপত্তির শুরু হয় দ্বিতীয় বছরে। গাছ ভাল হলেও ফলন মোটেই ভাল হয়নি। তার পরের বছর গাছ শুধুই বেড়ে চলে, ফলন প্রায় শূন্য। কোনও পথ না-পেয়ে তিনি হাজির হন জেলা উদ্যানপালন দফতরে। ওই দফতর তখন নির্দিষ্ট পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহারের পরামর্শ দেয়।
সেই ঘটনা এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারেন হুগলির তৎকালীন উদ্যানপালন আধিকারিক দীপক ঘোষ। তিনি বর্তমানে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নীতি আয়োগের কথা শুনে তিনি বলেন, ‘‘গোবর সারে মাটির অম্লতা কাটে, জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ে। গাছের বৃদ্ধি হয়। কিন্তু তাতে ফলন বাড়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই।’’ তাঁর যুক্তি, কোনও সার ছাড়াই রাস্তার ধারের গাছে ফুল-ফল হয়। কিন্তু তা বলে কি বিনা সারে চাষ করা যায়?
সোমবার নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিতে এসেছিলেন কৃষিবিদ সুভাষ পালেকর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, তিনি বলেছেন, গোবর, গোমূত্র, গুড়, পিঁপড়ের বাসা আর ডালের গুঁড়োর মিশ্রণ পচিয়ে জমিতে দিলেই কেল্লাফতে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক আর লাগবে না। জলসেচও প্রয়োজন হবে যৎসামান্য। চাষের খরচ নামবে প্রায় শূন্যে। দেশীয় বীজেই ফলন হবে হাইব্রিড বীজের থেকে বেশি। আর এই দাওয়াই নাকি মনে ধরেছে নীতি আয়োগেরও!
দীপকবাবুর সুরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই মনে করছেন, যে পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে, তাতে দেশের কৃষি ব্যবস্থা ১০০ বছর পিছিয়ে যাবে। মার খাবে উৎপাদন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-রসায়ন এবং মৃত্তিকাবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিশ্বপতি মণ্ডল এতটাই ক্ষুব্ধ যে তিনি বলছেন, ‘‘নীতি আয়োগের মতো সংস্থা এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করলে তার প্রতিবাদ হওয়া দরকার। রাজ্যগুলিকেই তা করতে হবে।’’
কিন্তু গোবর সারে চাষে এমন কী অসুবিধা?
বিশ্বপতিবাবুর দাবি, “অঞ্চল ভেদে এ দেশের মাটিতে বিভিন্ন উপাদানের ঘাটতি থাকে। আধুনিক কৃষিবিজ্ঞান বলছে, পাইকারি হারে রাসায়নিক সার প্রয়োগ না করে, মাটিতে যা ঘাটতি রয়েছে সেই সার দিলেই ফসল হবে সবচেয়ে ভাল।” তাঁর ব্যখ্যা, ধরা যাক, কোনও জমিতে বোরনের ঘাটতি ৩৫ শতাংশ। আর নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাসের ঘাটতি যথাক্রমে ১০, ২৫ এবং ৪০ শতাংশ। ১০ লিটার গোমূত্রে নাইট্রোজেনের চাহিদা কমবে ২ শতাংশ। ১০ কেজি গোবর সারে নাইট্রোজেন-ফসফেট-পটাস পাওয়া যাবে প্রয়োজনের মাত্র ৪-৫ শতাংশ। পুরো ঘাটতি মেটাতে গেলে কুইন্টাল কুইন্টাল গোবর সার লাগবে, আর গ্যালন গ্যালন গোমূত্র। অথচ ঘাটতি রয়েছে এমন সার মাত্র ২-৩ কেজি দিলেই প্রয়োজন মিটে যাবে।
তা হলে সিঙ্গুরের ওই চাষি প্রথম বছর ভাল ফলন কী করে পেলেন?
বিশ্বপতিবাবু বলেনন, “দেশের যে কোনও প্রান্তে এটা ঘটবে। জমিতে রাসায়নিক সার থেকে যায়। ফলে গোবর সার দিলে মাটির গুণগত মান ভাল হয়। সেই জন্য প্রথম বছর ফলন ভাল হয়।” কৃষিবিজ্ঞানীরা জোর দিচ্ছেন মিশ্র সার প্রয়োগে। অর্থাৎ, রাসায়নিক সারের সঙ্গে জৈব সার। কয়েকজন কৃষি বিজ্ঞানী আবার বলছেন, কেন্দ্র মাটির স্বাস্থ্য ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে। তাতে ভরসা রাসায়নিক। এর মধ্যে সরকারেরই একটি সংস্থা বিভ্রান্তি ছড়ানোয়
হতাশ তাঁরা।