অবন্তিকা ভট্টাচার্য
ফেসবুকে চার লাইনের একটা পোস্ট। তার পরেই সব চুপচাপ। নিজের চাকরিতে বদলির বিষয়ে তিনি এমন পোস্ট করলেন কেন, ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছিলেন না তরুণী চিকিৎসকের আত্মীয়-পরিচিতেরা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই জানা যায়, অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ওই চিকিৎসক!
পনেরো দিন লড়াইয়ের পরে সোমবার অবন্তিকা ভট্টাচার্য (৪০) নামে বেহালার ওই চিকিৎসকের মৃত্যু হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রায় আট বছর সহকারী শিক্ষক-চিকিৎসক ছিলেন তিনি। কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক অবন্তিকাকে গত মে মাসে ফের একই পদে বদলি করা হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি নিয়ে মানসিক অবসাদের কথাই ১৬ অগস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রাক্তনী অবন্তিকা। সূত্রের খবর, সেই রাতেই বেহালার বাড়িতে নিজেই গায়ে অ্যালকোহল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন ওই চিকিৎসক। ঘটনার সময় বাড়িতে ছিলেন অটিজমে আক্রান্ত আট বছরের মেয়ে এবং তার দেখভালের জন্য নিযুক্ত আয়া। অবন্তিকার স্বামী পেশায় স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অমিয় ভট্টাচার্য বহরমপুরে কর্মরত। প্রতি সপ্তাহেই তিনি বহরমপুরে যান।
ঘটনার পরেই আত্মীয়স্বজনেরা অবন্তিকাকে প্রথমে বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। তাঁর শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। পরের দিন অর্থাৎ ১৭ অগস্ট স্বাস্থ্য দফতরের হস্তক্ষেপে ওই চিকিৎসককে এসএসকেএম (পিজি) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সোমবার রাতে অবন্তিকার মৃত্যুর পরে রাজ্যের চিকিৎসক বদলির নীতিকেই দায়ী করেছে বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন। অবন্তিকার স্বামী অমিয় মঙ্গলবার বলেন, ‘‘আমায় তেমন কিছু না-বললেও ফেসবুকে বদলি নিয়ে মানসিক যন্ত্রণার কথা লিখেছিল।’’ পরিচিতেরাও জানান, বেশ কয়েক মাস ধরেই মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন অবন্তিকা। তার মধ্যে সব থেকে বড় কারণ ছিল দীর্ঘদিন প্রত্যন্ত জেলার পোস্টিং।
কলকাতায় আয়ার কাছে মেয়েকে রেখেই অবন্তিকা মেদিনীপুরে যাতায়াত করতেন। মেয়েকে নিয়েও উদ্বেগে থাকতেন তিনি। সমস্যার কথা জানিয়ে কলকাতার কোনও হাসপাতালে বদলি চেয়ে স্বাস্থ্য দফতরে আবেদনও করেছিলেন অবন্তিকা। কিন্তু সুরাহা হয়নি। বছর দুয়েক আগে তাঁর মা (পেশায় স্ত্রীরোগ চিকিৎসক) আগুনে পুড়ে মারা যান। সেই ঘটনার ছ’মাস আগে মারা যান অবন্তিকার বাবা। সব মিলিয়ে অবসাদ বাড়তে থাকায় মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছিলেন।
‘‘ফের জেলায় বদলির নির্দেশের এক মাস পর থেকেই খুব ভেঙে পড়েছিল অবন্তিকা। কোনও মতেই মানতে পারছিল না। বাচ্চা মেয়েটার সমস্যার কথা জানিয়ে আবেদন করলেও সুরাহা হয়নি। আবার সেই দূরেই বদলি করা হয়েছিল,’’ বলেন ওই তরুণীর এক আত্মীয়। গত ১৬ অগস্ট ওই চিকিৎসক
সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘আমার শান্তি কোথায়...চাকরি ছাড়লে? আট বছর প্রত্যন্ত জায়গায় চাকরির পরেও আবার টেনে নিয়ে যাওয়া হল আর এক প্রত্যন্ত জায়গায়। কোনও ভাবেই এটা নিতে পারছি না......।’
অবন্তিকার অপমৃত্যু ঘিরে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক টানাপড়েন। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরকে বিঁধে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী টুইটে লিখেছেন, অবন্তিকার অপমৃত্যু এড়ানো যেত। তাঁর অকালমৃত্যু শুধু রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের নীতি নিয়েই প্রশ্ন তুলছে না, ওই দফতরের শীর্ষ থেকে সব স্তরের কর্মী-অফিসারদের অপদার্থতাও প্রকাশ করে দিয়েছে। যাঁরা অবন্তিকার অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী, তাঁদের বিচার হবে কি, প্রশ্ন তুলেছেন শুভেন্দু।