ময়াল টিকে থাক সসম্মানে।
সুখের পায়রার কথা তো অনেক শুনেছি। কিন্তু সুখের সাপ-ব্যাঙ-ইঁদুর-বিড়াল শুনেছেন কখনও? অবশ্য সুখের পায়রা শব্দ দু’টির গায়ে অম্ল-মধুর বিদ্রূপের ছোঁয়া যে নেই তেমনটা বলছি না! তবে সেই কবে ছড়াকার শ্রী যোগীন্দ্রনাথ সরকার মনে হয় সুখী একটি সাপের কথা উপলব্ধি করেছিলেন। কবিকে আমরা সে ভাবে মনে না রাখলেও তাঁর ‘অ এ অজগর আসছে তেড়ে, আ এ আমটি আমি খাব পেড়ে’ আজও বাংলা-মাধ্যম-গৃহস্থ বাড়িতে টিমটিম করে হলেও টিকে আছে। নাদুস-নুদুস সেই হাসি মুখের অজগর হয়তো খেলার ছলে তেড়ে আসছে কচি-কাঁচাদের দিকে। যেন মামাবাড়ির আদর মিশিয়ে শিশুকে সে বলে— এই বেলা খেয়ে নাও বলছি, না হলে কিন্তু ভোম্বল ডাকাতকে ডাকব! শিশুমনে যেন এমন একটি সফট-আবহ এঁকে দেয় ছড়াখানি। এতই মোটাসোটা সেই সাপ, যে দিব্যচোখে ধরা পড়ছে তার ভুঁড়ি ও চর্বি।
ক’দিন আগে আনন্দবাজারের একটি খবর পড়ে মনে হল কথাগুলো। সত্যি কথা হল, পাইথন বা অজগর আসলে লম্বায় অন্তত ফুট বারো হয়। আর ওজন অনায়াসেই পঞ্চাশ কেজির ধারে-কাছে। খবরে বলা হয়েছে, পুনরায় বেশ কিছু সংখ্যক ময়াল সাপ দেখতে পাওয়া যায় ধুবুলিয়া, বেথুয়াডহরি সংলগ্ন জলা-জঙ্গলে। অভয়ারণ্যে একটি প্রাণী যখন নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় তার থেকে আনন্দের খবর কী বা হতে পারে? কিন্তু সর্প-দর্শন মানুষের মনে ভীতির উদ্রেক করে বলেই এই খবরটির কিছুটা সোশিও-বায়োলজিক্যাল বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়ে।
মল-মোবাইল কালচারে হ্যাপি আওয়ার, হ্যাপি পিল কথাগুলো জনপ্রিয়তা পেলেও ‘হ্যাপি স্নেক’ বলে কোনও শব্দ আমাদের সমাজে তৈরি হয়নি এখনও। এই যে ময়াল সাপের কথা বলছি আমরা, যারা আসলে অজগর (মানে পাইথন), তাদেরকে নির্দ্বিধায় ‘হ্যাপি স্নেক’ বলা যায়। এবং তারা নির্বিষ। অর্থাৎ এরা হল জগৎ-সংসারের সুখীতম সেই সাপ সদস্য, আলস্য এবং খাদ্য রসিকতায় যে ভেতো বাঙালিকে দশ গোলে হারাবে। ময়াল মূলত মাংস খায়। ছোট ছোট সাপ, ব্যাঙ, পাখি সাধারণত তার কাছে স্টার্টার, আর প্রিয় ডিশ কিছুটা বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী। এই যেমন ধরুন এ বাড়ির ছাগলছানা, ও বাড়ির বিড়াল। বুনো খরগোশের মাংস তো জিভে জল আনবেই। পাইথনের মুখে কালো হরিণশিশুর স্বাদই আলাদা। তার করাতের মতো চোয়াল সব হাড়গোড় মিহি করে দেয়। এ হেন ভারী খাদ্যরাশি তাঁকে নাকি সাত-আট দিনের ‘মিল স্কিপ’ করতেও বাধ্য করে। গুরুপাক ভোজনের পরে, এমনকি দু’বছর না খেয়ে থাকার ঘটনাও পাওয়া যায় এশিয়ার কোনও কোনও জঙ্গলে। এমনই সুখী তারা, এমনই আলস্য তাঁদের যে, পেট ভরা থাকলে আক্রমণকারীকেও নিশ্চিন্তে ‘জাস্ট’ ছেড়ে দেয় সে! এ বার আপনিই বলুন, ময়ালকে ‘হ্যাপি স্নেক’ না বলে পারা যায়?
ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান-সহ নেপাল ও পাকিস্তান ছাড়াও ভারতীয় ভূখণ্ডের জলে-জঙ্গলে তারা তো থাকবেই। কখনও অল্প-স্রোতের খালবিল আবার কখনও বা বুনো স্তন্যপায়ীর ফেলে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে গুহাতেও তাদের দেখা মেলে। তাদের ডিম দেখে কোনও পাখির ডিম বলে ভ্রম হতে পারে। তাই বলে ডিম চুরি করতে না যাওয়াই ভাল। সুখী মা-সাপ শরীরের ওম দিয়ে ডিমগুলি আগলে রাখে যে! এই কারণেই তাদের ‘পেরেন্টাল কেয়ার’ স্নাতক প্রাণিবিদ্যার সূচিতে স্থান পেয়ে যায়। আপনি হয়ত ভাবছেন, সাপ আবার সংসারী হয় নাকি? আজ্ঞে হ্যাঁ, সুখী সাপ শান্তিতে ঘরকন্না করে বলেই তো তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি প্রকৃতি থেকে। কৃষ্ণনগর বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসার শ্রী বিকাশ বিশ্বাস মহাশয় ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণ আইন অনুসারে ময়ালকে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী বললেও আজকের আইইউসিএন রেড ডেটা বুক বলছে পৃথিবীর বুকে পাইথন মোটেই বিপন্ন প্রজাতি নয়। সে বরং ‘লোয়ার রিস্ক লেভেল’-এ আছে। তাকে রাখা হয়েছে ‘নিয়ার থ্রেটেন্ড’ পর্যায়ে। জীববিজ্ঞান বলে, যে সমস্ত প্রজাতি প্রকৃতির কোলে গত পঞ্চাশ বছর ধরে নেই তারাই বিলুপ্ত। ময়ালের ক্ষেত্রে সে যুক্তি খাটে না। বিলুপ্তির নীচের স্তর হল বিপন্ন, যাদের জীবন বিলুপ্তির রাস্তায় আছে। এরা আবার তিন ভাগে টিকে রয়েছে। যেমন ‘ক্রিটিক্যাল’, ‘এনডেঞ্জারড’ ও ‘ভালনারেবল’। আগামী পাঁচ বছরে পঞ্চাশ শতাংশ বা তার বেশি বিলুপ্ত হতে পারে ক্রিটিক্যালরা। আগামী কুড়ি বছরে কুড়ি শতাংশ বিলুপ্তির সম্ভাবনা আছে এনডেনজার প্রজাতির। আর আগামী একশো বছরে পাঁচ থেকে দশ শতাংশ বিলুপ্তির আঁচ থাকলে তারাই হবে ভালনারেবল তালিকার প্রজাতি। এই তিন ভাগের কোনওটিতেই পড়ে না আমাদের অজগর। আইইউসিএন- এর মতে ময়াল লোয়ার রিস্ক প্রাণী। এর একটি ভাগ হল নিয়ার থ্রেটেন্ড। সুতরাং তারা বাংলার জলা পরিবেশে দাপিয়ে বেড়াবে সে তো সুখের কথা।
এখন প্রশ্ন হল পেস্টিসাইড ও রাসায়ানিক সারের দাপটে দেশি মাছ থেকে ব্যাঙ অনেকেই যখন বিলুপ্তির গ্রাসে চলে যাচ্ছে, সেই পরিবেশেও হ্যাপি ময়াল যে সসম্মানে টিকে আছে এ তো সৌভাগ্যের বিষয়। প্রকৃতিবিদের কাছে এর চেয়ে প্রীতিকর কী আর হয়? আসলে কথায় কথায় আমরা যে দূষণ-টুষণের অজুহাত দিই, নেচার সব সময় তা মানে না। সে তার নিজের নিয়মে আত্মরক্ষার বিশল্যকরণী প্রয়োগ করবেই। যদি বলেন, দূষণের কারণেই তো এতো ভূমিকম্প, এতো বন্যা। তবে যুক্তি হল পাঁচ হাজার বছর আগেও তো বন্যা ও ভূমিকম্প ছিল। তাই তো আমরা আজকের কয়লা ও পেট্রোলিয়াম পেয়েছি। তবে কি সেকালেও দূষণ ছড়াত ‘প্রিমিটিভ ম্যান’? নিশ্চয় নয়। তাই অনেক কিছুই প্রকৃতির নিয়মে ওলটপালট হয়। আমাদের জ্ঞান-চোখ এখনও সব ধরতে পারেনি।
তবে ধরা পড়েছে অজগর (ফের ময়াল ধুবুলিয়ায়, আবাপ/ ০৩.০৯.১৮)। আমি বলব, দেখা যাক তাদের, তবে যেন ধরা না পড়ে। খুশি মনে পৃথিবী ভোগ করুক সেই সরীসৃপ। পেটুক মনে যত খুশি খাক। তার পরে না হয় সুখে নাক ডাকুক অভয়ারণ্যের কোলে বয়ে চলা গুড়গুড়ি খালের স্যাঁতস্যাঁতে বিছানায়। বরং দূর থেকে দোয়া-প্রার্থনা করি আমরা। আমরা, এই মেকি-জটিল পলিটিক্যাল মানুষগুলো। যারা দু’টি পা নিয়েও, পনেরোশো সিসির মস্তিস্ক নিয়েও, তুমুল স্তন্যপায়ী হয়েও মনে মনে সরীসৃপ হয়ে থেকে গেলাম আজীবন।
ডারউইন স্বর্গ থেকে দেখুন, ল্যামার্ক জান্নাত থেকে দেখুন, এটাই কি দর্শন ছিল আপনাদের? আমি অন্তত মানি না।