পরপর দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরেও ঘুম ভাঙেনি প্রশাসনের

শহরে নেই ট্রাফিক পুলিশ

দিন কয়েকের ব্যবধানে শহরে ঘটে গিয়েছে পর পর দু’টি দুর্ঘটনা। একটিতে মৃত্যু হয়েছে দুই বাইক আরোহীর। অন্যটিতে নিহত এক স্কুল ছাত্র। দু’টি দুর্ঘটনা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, বোলপুরের পথ-নিরাপত্তা নিয়ে। অভিযোগ উঠেছে, সময়ে স্ট্যান্ডে ঢোকার জন্য নানান রুটের বাস শহরে ঢুকেই গতি বাড়িয়ে দেয়। অন্য দিকে পুলিশের উদাসীনতায় দুরন্ত গতিতে চলছে কয়লা পাচারের ট্রাকও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বোলপুর শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:২০
Share:

দুর্ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরেও ছবিটা বদলালো না চিত্রা মোড়। ছবি:বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

দিন কয়েকের ব্যবধানে শহরে ঘটে গিয়েছে পর পর দু’টি দুর্ঘটনা। একটিতে মৃত্যু হয়েছে দুই বাইক আরোহীর। অন্যটিতে নিহত এক স্কুল ছাত্র। দু’টি দুর্ঘটনা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, বোলপুরের পথ-নিরাপত্তা নিয়ে। অভিযোগ উঠেছে, সময়ে স্ট্যান্ডে ঢোকার জন্য নানান রুটের বাস শহরে ঢুকেই গতি বাড়িয়ে দেয়। অন্য দিকে পুলিশের উদাসীনতায় দুরন্ত গতিতে চলছে কয়লা পাচারের ট্রাকও।

Advertisement

লালপুল পেরিয়ে চিত্রা মোড়ের উপর দিয়েই যে রাস্তাটি চলে গিয়েছে লজ মোড় হয়ে জামবুনি বাসস্ট্যান্ড, ঘটনাচক্রে দুর্ঘটনাপ্রবণ ‘জোন’ হয়ে উঠেছে এই মোড়গুলি। শহরের ব্যস্ততম মোড়ের একটি চিত্রা। শুধু শনিবারের দুর্ঘটনা নয়, অভিজ্ঞতা থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা বার বার প্রশাসনকেই দুষছেন শহরের পথ-নিরাপত্তা নিয়ে। গত ১৫ তারিখ মকরমপুরের বন্ধুমহল ক্লাবের সামনে দুর্ঘটনার পর শনিবারের দুর্ঘটনায় বাসিন্দারা ক্ষোভও দেখিয়েছেন। যার আগুনে পুড়েছে ট্রাকটি। পুলিশ-প্রশাসন অবশ্য দুটি ঘটনার পরও নির্বিকার!

শনিবার ঠিক কি হয়েছিল?

Advertisement

শনিবার সকালে বোলপুরের চিত্রা মোড়ে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাবে বলে অপেক্ষা করছিল পাঠভবনের একাদশ শ্রেণির ছাত্র শুদ্ধসত্ত্ব চট্টোপাধ্যায়ের (১৭)। আচমকা কয়লা বোঝাই একটি ছোট ট্রাক এসে সজোরে ধাক্কা মারে। ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। জানা যায়, ঘাতক ট্রাকটিতে ধানের তুষ দিয়ে ঢেকে কয়লা পাচার করা হচ্ছিল। কার্যত পুলিশের ভূমিকায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। পুলিশের সামনেই তাঁরা ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়। জ্বলতে থাকে ট্রাকটি। স্কুলছাত্রের দেহ আটকে শুরু হয় অবরোধও।

ঘটনা হল, বোলপুর-লাভপুর বা বোলপুর-পালিতপুরের মতো যে সমস্ত বাসরুটের বাস যাতায়াত করে এই রাস্তার উপর দিয়ে, তাদের অধিকাংশই লালপুল পার হয়ে গতি বাড়িয়ে দেয়। এতে চিত্রামোড় বা লজমোড়ের মতো এলাকায় দুর্ঘটনা নিত্য দিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, কাছেই রয়েছে এসডিপিও অফিস ও বোলপুর থানা। বছরের নানা সময় ভিআইপি-রাও এই পথেই গাড়িতে যাতায়াত করেন। অথচ, একরকম পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই এই রাস্তায় চলছে বেআইনি খনির কয়লা বোঝাই ট্রাক। দুবরাজপুর, খয়রাশোল ও কাঁকরতলা থেকে আসা কয়লা বোঝাই করে তা এই পথেই ট্রাকে পাচার হয় বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায়।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, বীরভূমের বেশ কিছু থানা এলাকা যেমন খয়রাশোল, কাঁকড়তলা, দুবরাজপুর, রাজনগর প্রভৃতির ওপর দিয়ে কয়লা যায়। ঝাড়খণ্ডের সীমানা গ্রাম দুবরাজপুর থানার আদমপুর এলাকায় বেশ কিছু জায়গায় বেআইনি কয়লার ডিপো রয়েছে। ওই সমস্ত এলাকায় পরিবহণ বলতে গোরুর গাড়ি। কিন্তু কয়লার ডিপো থেকে একাধিক যানবাহনের মাধ্যমে কয়লা পাচার হয়। সাধারনত, দুবরাজপুর থানা এলাকার পাওয়ার হাউস মোড়, নিরাময় টিবি হাসপাতালের পরে সাহাপুর এলাকায় কয়লার ডিপো থাকে। সেই কয়লা বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে রাজনগর, তাঁতিপাড়া, বক্রেশ্বর, খয়ারাশোল, কাঁকড়তলা, লোকপাড়া এলাকার কয়লা ডিপোতে যায়। এজেন্টের মারফত ডিপো থেকে ওই কয়লা গাড়িতে লোড হয়ে চলে যায় বাইরের জেলাতেও। লোড হওয়ার পরেই গাড়ির নম্বার সহ রুট চার্ট দিয়ে খবর আসে থানায়। নামপ্রকাশ না করার শর্তে, এক কয়লা পাচারকারীর কথায়, “কয়লার গাড়ি যে সমস্ত থানার ওপর দিয়ে যায়, সেই সমস্ত থানার পুলিশের একাংশ জড়িয়ে রয়েছে এই অবৈধ চক্রের সঙ্গে।” অনেক সময় পুলিশের নজর এড়িয়ে পালাতে গিয়েও দুর্ঘটনায় পড়ে ট্রাকগুলি।

স্থানীয় সূত্রে খবর, কয়লা পাচারের গাড়ি ইলামবাজার পেরিয়ে বোলপুরের আগে ভিআইপি মোড়ে আসে। সেখান পুলিশের চেকিংও হয়। এখান থেকে দুটি রাস্তা দিয়ে কয়লার গাড়ি বোলপুর শহর পার হয়। একটি সুরথেশ্বরতলা হয়ে জাতীয় সড়ক(২বি)ধরে বর্ধমানের দিকে যায়। অন্য দিকে এই মোড় থেকে মহিদাপুর হয়ে কিছু গাড়ি শ্রীনিকেতন-জামবুনি-চিত্রা মোড় পার হয়। জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, বোলপুরের আগে ভিআইপি রোডের মুখে দু’দিকে বোলপুরে ঢোকে ওই সব কয়লা বোঝাই গাড়িগুলি। কাশীপুরের দিকে ঢুকতে হলে ওজন করতে হয়। অন্যদিকে বোলপুর ত্রিশুলাপট্টিতেও রয়েছে গাড়ি-সহ ওজনের জায়গা। এই দুটি জায়গায় গাড়ির চালকেরা বেআইনি কয়লা নামানোর পর ফের খালি গাড়ি ওজন করান। সূত্রের খবর, বেআইনি কয়লার টাকা, ঠিক চলে যায় মালিকের হাতে।

জেলা পুলিশের সূত্রে খবর, বোলপুর শহরের উপর দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ২০টি গাড়িতে কয়লা পাচার হয়। শহরের মধ্যে দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে এই সমস্ত কয়লা বোঝাই ট্রাকগুলি। গতির জন্য স্থানীয়দের কাছে যা আতঙ্কেরও। লালপুল থেকে লজমোড়- এই এলাকায় যে সমস্ত দোকান-বাজার রয়েছে, আতঙ্কে থাকেন তাঁরাও। “সাইকেল, বাইক কোনও কিছুই রাখতে ভরসা পাই না। যে ভাবে ঘাড়ের উপর ছুটে আসে বাস-ট্রাক! একরকম পালিয়ে বাঁচি বলতে পারেন। যে কোনও দিন বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”

শহরের মধ্য দিয়ে কয়লার গাড়ি আটকাতে পুলিশ কেন উদাসীন?

জেলা পুলিশের একটি মহল এই পাচারকারীদের মদত দিচ্ছে বলে অভিযোগ। শনিবার চিত্রা মোড়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের যেমন অভিযোগ ছিল, রক্তাক্ত ছাত্রটিকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে পুলিশের তৎপরতা শুরু করে কয়লা বোঝাই গাড়িটিকে নিয়ে। এছাড়া, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বেআইনি কয়লা পাচার গাড়ির ডেলিভারি অর্ডার বানিয়েও গাড়ি ছাড়া হয়।

স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “কয়লার গাড়ি শুধু নয়, বেশির ভাগ রুটের বাস স্ট্যান্ডে দেরিতে ঢোকে। ফলে সময়ের মেকআপ দিতে গিয়ে লালপুল পেরিয়েই গতি বাড়িয়ে দেয়। আর ট্রাকের তো কোনও স্টপ নেই। বেপরোয়া ভাবে এই ব্যস্ত রাস্তায় দিনের পর দিন গতি বাড়িয়ে যাতায়াত করে। কার্যত বোলপুরে কোনও পথ-নিরাপত্তা নেই।” শহরের ভিতর বিভিন্ন রুটের বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু দিন আগেই একটি বৈঠক হয়েছিল বাস মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে। সেখানে ঠিক হয়, শহর থেকে বাইরে যেতে বাসগুলি যে সময় নেয়, ঢোকার সময়ও একই সময় নেবে। অভিযোগ, সে সিদ্ধান্তও মানা হয়নি। আগের মতোই দ্রুত গতিতে বাসগুলি শহরে ঢোকে। বোলপুরের মহকুমাশাসক মলয় হালদার বলেন, “বিষয়টি জানা নেই, পুলিশ সঙ্গে কথা বলে দেখছি।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement