স্থানীয়রা আটকে রেখেছে সেই ট্রেলার। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত
রাতের অন্ধকারে শহরের মধ্যে দিয়ে বেআইনি ভাবে ট্রেলারে বিশাল বাক্স চাপিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ওই ট্রেলারের সঙ্গে সংঘর্ষেই ছিঁড়ল বিদ্যুত্বাহী তার, কেবল ও ইন্টারনেটের তার। যে ঘটনার জেরে দীর্ঘ ক্ষণ বিদ্যুত্ ও কেবল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকল এলাকায়। শনিবার ভোর রাতে এমনটাই ঘটেছে দুবরাজপুর শহরের রঞ্জনবাজারে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, গভীর রাতে রোজ দিন স্থানীয় এলাকারই কয়েক জন দায়িত্ব নিয়ে বেআইনি ভাবে এ ভাবে ভারী ট্রেলার শহরের রাস্তা দিয়ে পার করিয়ে দেয়। বিনিময়ে মোটা টাকা পেয়ে থাকে। এই বেআইনি কার্যকলাপে পুলিশের একাংশের মদত থাকে বলেও বাসিন্দাদের দাবি।
এ দিকে, বিষয়টি জানাজানি হতেই শনিবার ভোর রাত থেকেই ক্ষতিপূরণের দাবিতে ট্রেলারটিকে দিনভর আটকে রাখেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরে এলাকারই কয়েক জন রবিবার রাতে সেটিকে শহর পার করিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, পুলিশের একাংশই যেখানে সমাজবিরোধীদের সাহায্য করছে, তখন শুধু শুধু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী! তবে, এমনটা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না বলেই তাঁরা মনে করছেন। পুলিশ অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশের পাল্টা দাবি, বেআইনি ভাবে ঢুকে পড়া গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সঙ্গে সঙ্গেই থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ভবিষ্যতে যাতে এমনটা না ঘটে, তা দেখা হবে।
শহরের মধ্যে দিয়ে কেন এই বেআইনি পারাপার চলে?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, অতীতে পানাগড়-দুবরাজপুর রাজ্য সড়ক হয়ে আসা ভারী ও বিশাল আয়তনের বস্তু বোঝাই ট্রেলারগুলি দুবরাজপুর থেকে রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরত। সে ক্ষেত্রে সিউড়ি শহরকে বাইপাস করে সিউড়ি স্টেশনের আগে পূর্ব রেলের অন্ডাল-সাঁইথিয়া রেল রুটের লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে যেত সচ্ছন্দেই। কিন্তু, ওই শাখায় বৈদ্যুতিকরণ হয়ে যাওয়ায় ওভারহেড হাইটেনশন তার লাগানো হয়েছে। সমস্যার শুরু সেখানেই। ওই রাস্তা দিয়ে উঁচু বস্তু বোঝাই ট্রেলার বা ওই ধরনের যান পারাপার করতে হলে আগাম রেলের অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি মিললে প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা রেলকে দিলে বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে যানটিকে লেভেল ক্রসিং পার করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে রেলই। কিন্তু, তা সময় সাপেক্ষ এবং খচর সাপেক্ষও বটে। যে কারণে সমস্যায় পড়ে ওই ধরনের যানবাহনগুলি।
অভিযোগ, সেই অসুবিধা এড়াতে চাওয়া চালক বা সংস্থাকে মধ্যবর্তী পথ দেখাচ্ছে এলাকারই কিছু মানুষ। তারা ওঁত্ পেতে অপেক্ষা করে কখন ওই ধরনের যান আসবে। এমন ট্রেলার পেলেই দুবরাজপুরের সাতকেন্দুরি বাইপাস থেকে মোটা টাকার চুক্তিতে তারা সেটিকে দুবরাজপুর শহরে ঢুকিয়ে দেয়। বাঁশের আগায় বাতা বেঁধে শহরের বিদ্যুত্ ও কেবল তার ঠেলে ট্রেলারটিকে একবার বক্রেশ্বর রাস্তা ধরিয়ে দিতে পারলেই কাজ শেষ। কারণ, সেটি বিনা বাধায় বক্রেশ্বর, চন্দ্রপুর, কড়িধ্যা হয়ে জাতীয় সড়কে পৌঁছে যাবে। অথচ লেভেল ক্রসিং পার হতে হবে না। কিন্তু, শহরের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বিপত্তি আছেই। বিশেষ করে বাইপাস রাস্তায় গায়ে গায়ে বাড়ি। অত বড় গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে ধাক্কা লাগলে ভেঙে যেতে পারে বাড়ি। এমন ভারী গাড়ির ধাক্কায় রাতের অন্ধকারে বাড়ির কার্নিশ ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটেছে। ফলে ঘর ভাঙার ভয় যেমন রয়েছে, তেমনই রাস্তার ঠিক উপরের বিদ্যুত্বাহী তারের জট অসাবধানতায় ছিঁড়ে আগুন লেগে বিপদও ঘটতে পরে। ঠিক যেমনটা হয়েছে শনিবার ভোরে।
পুলিশ সূত্রের খবর, বিহারের রৌক্সোল যাওয়ার পথে দুবরাজপুর শহরের মধ্যে দিয়ে এ ভাবে যাওয়ার টোপ গিলে ফেলেছিলেন ট্রেলার চালক উতেম রায়। একাধিক তার ছিঁড়ে এগোনোর পথেই দুবরাজপুরের রঞ্জনবাজারের কাছে এক যুবকের চোখে পড়ে যায় ঘটনাটি। হাঁকডাক শুরু করতেই পালিয়ে যায় রাস্তা পার করানোর দায়িত্বে থাকা এলাকার কয়েক জন। থামানো হয় ট্রেলারটি। কী করবেন যখন বুঝতে পারছেন না চালক উতেম, তখনই ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছয় পুলিশ। চালককে ‘উদ্ধার’ করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ ফের ঘটনাস্থলে এসে বাসিন্দাদের ক্ষোভের আঁচ পেয়ে ট্রেলারটিকে নড়ানোর কোনও উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ। উদ্যোগ নিয়েছিল রবিবার গভীর রাতে বলে বাসিন্দাদের দাবি। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে হাজির ট্রেলার পারাপারে মদতদাতা কয়েক জন। বাসিন্দারা তাই আর প্রতিরোধ গড়ার সাহস দেখাননি বলে জানিয়েছেন।
এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে দুবরাজপুরের পুরপ্রধান পীযূষ পাণ্ডে বলেন, “ঘটনার কথা শুনেছি। প্রথমত, যে বাইপাস রাস্তা ধরে ট্রেলারগুলি ঢুকছে, সেটা মোটেও ওই ধরনের ভারী যানবাহন যাতায়াতের রাস্তা নয়। রাস্তা খারাপের পাশাপাশি বিপদ ঘটার আশঙ্কাও তাই থাকছে। অবিলম্বে এমনটা বন্ধ করতে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।” যোগাযোগ করা হলেও এ ব্যাপারে জেলার এসপি অলোক রাজোরিয়ার প্রতিক্রিয়া মেলেনি।