ধানের গোলার উপরে লক্ষ্মীমূর্তি।
সাদা রঙের লক্ষ্মী মূর্তিটার দিকে নজর না গিয়ে উপায় নেই!
ইলামবাজার ব্লকের শীর্ষাগ্রামে নায়কদের দুর্গামন্দিরে যাওয়ার বেশ কিছুটা আগেই শতাব্দী প্রাচীন ধানের গোলার ঠিক মাথায় সিমেন্টের তৈরি এ মূর্তি। তার গড়নে কোথাও কি রানি ভিক্টোরিয়ার আমলের ছাপ? খুব স্পষ্ট, ভিক্টোরিয়া যুগের আদল। গোলা ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়েই প্রথমে নাট্যশালা। ডান দিকে ঘুরতেই দুর্গামণ্ডপ।
দুর্গামণ্ডপ বলে দুর্গামণ্ডপ?
সুবিশাল সে দুর্গামন্দির। পঞ্চমীর বিকেলেও প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে তো চলছেই। হয়তো শেষেরই পথে, তবু খুদেদের বুঝি চিন্তার শেষ নেই। সিংহর কেশর লাগানো বাকি যে!
পুজো বাড়ির চেনা ব্যস্ততা এ বাড়িতেও। সামনেই পিতলের তৈরি সুদৃশ দোলা। পরিস্কারে ব্যস্ত পরিবারের মহিলা সদস্যরা। ৩০০০ বিঘার জমিদারির পাট চুকেছে, কিন্তু শীর্ষা গ্রামের নায়ক পরিবারের শতাব্দী প্রাচীন দুর্গা পুজোর কৌলিন্যে তেমন আঁচ পড়েনি। শতাব্দী প্রাচীন পিতলের দোলা থেকে সদ্য রং করা দুর্গা মন্দির সবেতেই সেই ছাপ স্পষ্ট।
জমিদারি আমলের রীতি মেনেই এখনও হয়ে আসছে পুজো। এর কারণ, পারিবারিক দুর্গাপুজো বা লক্ষ্মী পুজো বা অন্যান্য খরচ যোগাড় করার জন্য কয়েক পুরুষ আগে তৈরি করা এস্টেট এখনও বর্তমান। “এস্টেটের নামে যে জমি রয়েছে সেই জমির ফসলের উপর নির্ভর করে উঠে খরচ। এবং সেই ধানের গোলাটিও বর্তমানে কাজে লাগে। ফসল উঠলে রাখা হয় সেখানেই। একই ধূমধামের সঙ্গে পূজিত হন দেবী লক্ষ্মীও।” নিজেদের দুর্গামন্দিরের দাওয়ায় বসে সে কথাই বলছিলেন শীর্ষা নায়ক পরিবারের অন্যতম প্রবীন সদস্য রথীন নায়ক।
কী ভাবে শুরু হল পুজো? প্রশ্নের উত্তরে রথীনবাবু বলেন, “অজয়ের ধার শীর্ষা একসময় লোহার সামগ্রীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। জলপথে অজয় পেরিয়ে বর্ধমানের কাটোয়া হয়ে সেই সব সামগ্রী পৌঁছে যেত কলকাতায়য়। ১৩০ ঘর কর্মকার পরিবারের তৈরি করা লোহার কারবার ফুলে ফেঁপে উঠে ছিল। সেই ব্যবসায় যোগ দিয়েছিলেন নায়করাও।” তিনি জানান, অবস্থা বদলে গিয়েছিল নায়ক পরিবারেরও। চার পুরুষ আগে রামকল্প নায়কের সময়েই সম্ভবত দুর্গা পুজোর শুরু। ইলামবাজারের ওই গ্রামে যতগুলি প্রাচীন দুর্গাপুজো হয়ে থাকে সেই পুজোগুলির তুলনায় নবীন হলেও আমাদের পুজোও শতাব্দী প্রাচীন।
প্রাচীন পিতলের দোলা।
পুজো ধূমধাম করে হতে শুরু করে তাঁদের পূর্বপূরুষ রামকল্পের ছেলে রজনীকান্ত নায়কের সময় থেকে। তাঁর সময়েই ৩ থকে ৪ হাজার বিঘা সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। বর্তমানে সেই সম্পত্তি না থাকলেও পুজো আঙ্গিকের কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। পরিবারের বধূ উমা নায়ক বলেন, “নায়ক পরিবারের সদস্য বেড়ে এখন ৭০ জন। গ্রামে সকলে না থাকলেও পুজোয় সবাই আসেন।” পরিবারের সদস্য রুম্পা নায়ক, রুণা নায়কদের কথায়, “গ্রামে পুজোর সময়টায়, চার দিন দেদার খাওয়া-দাওয়া, যাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।”
বহুকাল আগে মন্দিরের নাট্যশালায় নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন হত। এখনও হয় তবে ভিড় বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি থেকে দূরে করা হয় অনুষ্ঠান। এ বারও দু’দিন কলকাতা দলের যাত্রা হবে। সপ্তমী ও অষ্টমীর দিন রাতে। তবে এত আনন্দের মধ্যে কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে সকলের মনে। বিশেষ করে খুদেদের। ষষ্ঠ শ্রেণির ইশিকা, অষ্টম শ্রেণির রুচিরা এবং চতুর্থ শ্রেণির পুড়ুয়া সুরঞ্জন নায়করা বলছে, “নিয়ম করে একাদশীর সকালে প্রতিমা বিসর্জন হয়। এবার যেহেতু পুজোর একদিন কমেছে তাই ছুটির আনন্দও কমে যাচ্ছে একদিন। তারপর ফের পড়তে বসা!”
—নিজস্ব চিত্র