স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যেই শুয়ে রয়েছে কুকুর। —নিজস্ব চিত্র।
হঠাৎ গিয়ে পড়লে বোঝা দায়, নেশার মুক্তাঞ্চল নাকি স্বাস্থ্যকেন্দ্র!
স্রেফ পরিকাঠামো এবং সদিচ্ছার অভাবে এমনই বেহাল দশা বোলপুরের ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। নেই উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও নজরদারি। তার অভাবেই বছরের পর বছর পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার জমি, জায়গা এবং আবাসনগুলি। ফলে বোলপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে থাকা এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রই এখন ভূত বাংলো হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দুপুরে রমরমিয়ে চলছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চত্বরের মাঝেই মদ,গাঁজা, ড্রাগসের ঠেক। কার্যত সমাজবিরোধী এবং অপরাধীদের দখলে থাকা এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ঢেলে সাজানোর দাবি তুলছেন বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, নেশার ঠেক ভেঙে পরিষেবাটুকু মিলুক।
সেই অর্থে বোলপুর শহরের ভিতর চিকিৎসা কেন্দ্র বলতে রয়েছে এই ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিই। বোলপুর-শ্রীনিকেতন রাস্তার ওপর প্রায় সাত দশকের কিছু বেশি দিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। শহরের স্কুল-কলেজ-ডাকঘর সংলগ্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ইনডোরটি ৬০ শয্যার। সেই অনুপাতে চিকিৎসক, সেবিকা, ফার্মাসিস্ট এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মী রয়েছেন। আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিনশো রোগী পরিষেবার জন্য আসেন। সেই মতো, প্রতিদিন ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সংক্রান্ত পরিষেবার দিতে হয়, বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল। এমন বেহাল দশার জেরে সামান্য কারণেও ‘রেফার’ করা ছাড়া উপায় থাকে না চিকিৎসকদের।
স্বাস্থ্য কেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৪০-৪৫ সাল নাগাদ ওই হাসপাতাল গড়ে ওঠে। এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী অর্জুনলালবাবুর দান করা প্রায় কুড়ি বিঘে জমি নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক হাসপাতাল এবং হাসপাতালের কর্মীদের আবাসন গড়ে তোলা হয়। এক সময় শহরের প্রাণকেন্দ্রের এই হাসপাতালের উপর গোটা শহরই অনেকটাই নির্ভর করত। স্থানীয়দের দাবি, দিন যত গিয়েছে, ততই বেহাল দশা হয়েছে এই হাসপাতাল। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং নজরদারির অভাবে কার্যত নরককুন্ডে পরিণত হয়েছে।
বোলপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান কৃষ্ণপদ সিংহরায়ের অভিযোগ, “এই হাসপাতালের দশা নিয়ে শহরের পুরপ্রধান থেকে মন্ত্রী সকলকে জানানো হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে এবং একাধিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বারে বারে লিখিতভাবেও জানানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট সব মহলে। কোনও লাভ হয়নি।” স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেহাল দশা গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকতেই নজরে এল। ভেঙে পড়েছে নির্মাণ। হাসপাতাল চত্বরে যত্র তত্র নোংরা, আবর্জনা ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে। কুকুর, বেড়াল, শুয়োরদের নিত্য আনাগোনা সর্বত্র। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রসূতি ওয়ার্ডের জানালা বেয়ে লাগোয়া জায়গায় দিন দুপুরে বসেছে মদ, গাঁজা এবং জুয়াড়িদের আড্ডা। রমরমিয়ে চলছে মাদকের বেচা-কেনাও। ইনডোর ও আউটডোরে পরিষেবা নিতে আসা রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়দের অভিযোগ, “চিকিৎসক-সেবিকা রয়েছেন। সর্বনিম্ন পরিকাঠামো বলতে যা বোঝায়, তাও রয়েছে। কিন্তু রোগ মুক্তির পরিবেশই নেই! যত্রতত্র নোংরা, আবর্জনার স্তুপ। মাতাল, জুয়াড়ি এবং সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতীদের আড্ডা। এ জায়গায় রোগ নিয়ে আসতেও ভরসা হয় না। নিরাপত্তাই বা কোথায়?”
পরিবেশ যেমনই হোক, এসবের মধ্যেই চিকিৎসা চলছে। এখনও বন্ধ্যাত্বকরণ ব্যবস্থার পরিষেবা পাওয়া যায় এই হাসপাতাল থেকেই। কুকুরে কামড়ানো, সাপে কাটা রোগী ও শিশু-মায়েদের টীকাকরণ চলছে নিয়ম মাফিক। সেই পরিষেবার দিতে দিতেই আতঙ্কে ভোগেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। বোলপুরের সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দায়িত্বে থাকা বিএমওএইচ চিকিৎসক সব্যসাচী রায় বলেন, “আমাদের সাধ্যমত পরিষেবা দিয়ে থাকি। একটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে রোগীরা যা স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিষেবা পাওয়ার কথা, তা দেওয়ার চেষ্টা করি। বর্তমান অনুমোদিত পরিকাঠামো অনুযায়ী পরিষেবা দেওয়া হয়।” দুপুর থেকে ওই হাসপাতাল চত্বরে যে নেশার ঠেক বসে, সে নিয়ে কার্যত কপালে ভাঁজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরও। স্থানীয় বাসিন্দা এবং রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের তোলা অভিযোগ অস্বীকার করেননি হাসপাতালের চিকিৎসক এবং কর্মীরা। তাঁদের দাবি, দিন কয়েক আগেই নেশার ঠেকের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে কার্যত বেশ কয়েকবার থানায় খবর দেওয়া হয়েছিল। অশ্রাব্য ভাষায় কু-কথা বলা এবং সমাজবিরোধীদের আড্ডা নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বর। কিন্তু থানায় জানানো হলেও, কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। সব্যসাচী বাবু জানান, ইতিমধ্যেই কিছু কিছু পরিত্যক্ত আবাসন সংস্কার করে কুষ্ঠ, টিবি, কফ পরীক্ষাগার, দন্ত বিভাগ খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা।
জেলা রোগী কল্যান সমিতির সভাপতি তথা রাজ্যের মৎস্য মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “পুরপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। হাসপাতাল চত্বরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন রাখা ও সীমানা পাঁচিল নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”