ফোন বাজলেই ছুটে হাজির হন লামিদি

দুর্গাপুজো উপলক্ষে শোভাবাজার রাজবাড়িতে চল থাকা শতাব্দী প্রাচীন প্রথায় দাঁড়ি টেনে দিয়েছিলেন তিনিই। দামোদর থেকে ২৩ টন ওজনের একটি বিপন্ন শুশুক উদ্ধার করে ৭ ঘণ্টা যাত্রা করে তাকে হুগলি নদীতে নিরাপদে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।

Advertisement

মহেন্দ্র জেনা

বোলপুর শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৫ ০০:২৮
Share:

ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায়ের আশ্রয়ে অবলা প্রাণি। —নিজস্ব চিত্র।

দুর্গাপুজো উপলক্ষে শোভাবাজার রাজবাড়িতে চল থাকা শতাব্দী প্রাচীন প্রথায় দাঁড়ি টেনে দিয়েছিলেন তিনিই।

Advertisement

দামোদর থেকে ২৩ টন ওজনের একটি বিপন্ন শুশুক উদ্ধার করে ৭ ঘণ্টা যাত্রা করে তাকে হুগলি নদীতে নিরাপদে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।

রাঢ়বঙ্গের নেকড়ে সংরক্ষণ থেকে গাছে পেরেক-ব্যানার-হোর্ডিং বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া, রাস্তার অবহেলিত কুকুর, বেড়ালদের স্থানীয় ও গাড়ি চালকদের অত্যাচার থেকে বাঁচানো, কচ্ছপ বিক্রি ও পরিযায়ী পাখিদের রক্ষা— এই সবেতেই মুশকিল আসানের একটাই নাম ‘লামিদি’। শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায়কে একডাকে ওই নামেই চেনে বোলপুরবাসী। বিপন্ন পশু-পাখি-পরিবেশ রক্ষায় যাঁর জুড়ি মেলা ভার। শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লিতে অবস্থিত লামিদির বাড়ি ওই সব অবলা আশ্রয়হীনদেরই নিরাপদ ছায়াঘরে পরিণত হয়েছে। যেখানে ঠাঁই পেয়েছে হেমা (এই রেসের ঘোড়াটি অসুস্থ ও পরিত্যক্ত হয়ে কলকাতার রাস্তায় পড়েছিল। লামিদিই তাকে উদ্ধার করে সুস্থ করেছেন), বুল্টি (কুকুর), টুপলাইরা (বেড়াল)। শুধু বোলপুর বা বীরভূমই নয়, রাজ্য ছাড়িয়ে ওই অবলাদের জন্য লামিদির আশ্রয় ছড়িয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যেও।

Advertisement

পরিবার, হেঁশেল সব সামলে এ সব কী ভাবে পারেন?

বাড়ির উঠোনে জনা পনেরো হনুমানের একটি দলকে আলু খাওয়াতে খাওয়াতে ঊর্মিলাদেবী বলে উঠলেন “আসলে এই পথটা এতটা সুগম নয়, যতটা এখন খালি চোখে দেখলে বোঝা যায়। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে সমানে টানা লড়ে যাচ্ছি। লড়াই, সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি আজও। এখনও তা চালিয়ে যাব। আসলে ইচ্ছাশক্তির জোরে যে কোনও অসাধ্য সাধন হতে পারে।” সেই জোরেই ওই বছর দুর্গাপুজার সময় জ্যান্ত নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর কয়েকশো বছরের পুরনো পারিবারিক রীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে নববধূ হয়ে আসা ঊর্মিলাদেবী।

তিনি জানান, ওই পাখি কেনার নাম করে বিক্রেতার ঠিকানা জোগাড় করেছিলেন। পুলিশ এবং বন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনাস্থলে হানা দিয়েছিলেন। গোটা অভিযানের জন্য তাঁকে কম ‘নাটক’ করতে হয়নি। ঊর্মিলাদেবীর কথায়, “বাড়ির নতুন ঘোমটা পড়া বৌয়ের পক্ষে বিষয়টা সেই সময় মোটেই সুখকর হয়নি!” তার পর থেকে রাজবাড়িতে প্রতীকী ভাবে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর রেওয়াজ চলছে।

আর পিছনে তাকাননি লামিদি। শুরু করেছেন বন্য প্রাণি সংরক্ষণ আইনের আওতায় থাকা জীবজন্তুদের সংরক্ষণ এবং তাদের বাঁচাতে আইনি লড়াই। সেই সঙ্গে চোরাশিকারীদের প্রয়োজনীয় শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন। এই সব করতে গিয়ে তাঁকে কখনও গালাগালি শুনতে হয়েছে, কোথাও উড়ে এসেছে তির্যক মন্তব্য। কিন্তু, কোনও কিছুতেই তিনি দমেননি। প্রয়োজনে বুঝিয়েছেন, আবার দরকার হলে আইনি পথে হেঁটেছেন। ইতিমধ্যে বোলপুর, শান্তিনিকেতনের গণ্ডি পেরিয়ে রাঢ় বঙ্গ এবং ওড়িশার সুদূর ময়ূরভঞ্জের শিমলিপাল, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি জায়গায় নিজের লড়াই জারি রেখেছেন লামিদি। অতীতে বীরভূমের সাম্মানিক ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেনও হয়েছেন।

এই চলার পথে নিজের এলাকা বোলপুর-শান্তিনিকেতন রোডে চোরাই ভারতীয় পাখি বিক্রি আটকাতে গিয়ে ঊর্মিলাদেবীকে রীতিমতো হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছিল। তাঁর কথায়, “গাড়ি আটক করে ঘণ্টা দু’য়েক ধরে কার্যত বন্দি করা হয়েছিল আমাকে। কিন্তু, আমি আইনি ব্যবস্থা নিইনি। নির্যাতন সহ্য করে ওই বিক্রেতাকে বুঝিয়ে তাঁর ভুল শুধরেছিলাম।” একই ভাবে এলাকার সাপ ধরে খেলা দেখানো বন্ধ থেকে নানা কবিরাজি ওষুধ তৈরির নামে বন্য প্রাণি হত্যাও তিনি আটকেছেন। তাঁর দেখাদেখি এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে এলাকার অনেকেই। তরুণ প্রজন্ম থেকে রিকশাওয়ালা, বাড়ির বধূ সকলেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অবলা জীবজন্তুদের সহায়তায়। লামিদি পাশে পেয়েছেন স্নাতকের ছাত্রী ঐন্দ্রিলা সরকার থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ ঋষভ মুখোপাধ্যায়, রিকশাচালক বীরেন মাহাতো, দোকানদার বাবু হাজরা, স্থানীয় বাসিন্দা জীবন হাজরা, সুনীতা ধীবরদের মতো গৃহবধূদেরও। তবে, এ কাজে ঊর্মিলাদেবীর ডানহাত ছিলেন তাঁরই ছাত্রী তথা সীমান্তপল্লির বাসিন্দা টুটুল সিংহ। সবাই মিলে এলাকার আশ্রয়হীন নেড়ি কুকুর, বেড়ালদের বহরমপুরে নিয়ে গিয়ে নির্বীজকরণ করানো, অসুস্থদের সেবা থেকে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। পরে অবশ্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও এগিয়ে এসেছে।

আজও সমানে খবর আসে। কোথাও সাপ ধরা পড়েছে, কোথাও কচ্ছপ। কোথাও আবার বিপদে পড়েছে হনুমান। তাঁর ফোন ক্রমাগত বেজে চলে। ছুটে যান লামিদি। তিনি শুধু বলছেন, “অবলা পশুপাখিদের প্রাপ্যটুকু ফিরিয়ে দিতেই তো লড়াই। কখনও মনেই হয়নি আমি এক জন মহিলা হিসেবে এ সব করছি। মানুষ হিসেবে ওদের জন্য লড়াই করছি। শেষ দিন পর্যন্ত করে যাব।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement