টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে দুই যুবক দুরন্ত গতিতে মোটরবাইক ছুটিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা দূরে মোটরবাইক ও সাইকেলে তাদের পিছু ধাওয়া করছিল অতি উত্সাহী ছেলে ছোকরাদের দল। সঙ্গে কয়েকজন ভিলেজ পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ার। তারও খানিক পিছনে পুলিশের গাড়ি।
কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। পাকা রাস্তা ছেড়ে মোটরবাইক পাশের মোরাম রাস্তা ধরতেই জলকাদায় চাকা পিছলে পাশের জঙ্গলে ছিটকে গেল চালক। অন্যজন মাটিতে আছড়ে পড়েও কোনওরকমে উঠে পালানোর মতলব করছিল। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে জুটে গিয়েছিল ছোকরাদের দল। তারা হামলে পড়ে ওই যুবকের উপর। এক সিভিক ভলান্টিয়ার সপাটে চড় কষিয়ে বলেন, “ব্যাটা যা দৌড়িয়েছিস তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দেব!” বাকিরাও হাত গুঁটিয়ে ছিলেন না। হাত এবং পায়ের যতরকম কসরত্ জানা ছিল সবই প্রয়োগ হল। মাটিতে লুটোপুটি খাওয়া বিধ্বস্ত যুবকের তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। সে জনতার উদ্দেশ্যে হাত জোড় করে বলে, “ভাইসাব গলতি হো গয়া। মুঝে পুলিশমে দো।” শনিবার বিকেলে পুঞ্চা থানার কুরকুটা গ্রামের ওই ঘটনাস্থলে ঠিক সেই সময়েই পৌঁছয় ধাওয়া করা পুলিশের গাড়ি। জনতার হাত ছাড়িয়ে ওই যুবককে পাকড়াও গাড়িতে তোলেন পুলিশ কর্মীরা। জনতার মধ্যে অনেকে তখন হাতের সুখে কিছুটা কম হয়ে গেল বলে আফশোস করছিলেন।
খাতড়ায় ছিনতাই করা টাকার ব্যাগ অবশ্য ওই যুবকের কাছে ছিল না। সেই টাকার থলি নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে ছিটকে গিয়েছিল অন্যজন। সে টাকার ব্যাগটি নিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। কিছুটা দূরে বদড়া গ্রামে তাকে পাকড়াও করে সিভিক ভলান্টিয়ার ও গ্রামবাসী। তাঁর কপালেও উত্তম-মধ্যম জোটে। শেষে পুলিশের খপ্পরে।
পুরুলিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য বলেন, “ওই দুই ছিনতাইকারী রামকুমার যাদব ও অভিষেক যাদবের বয়েস ২৫-৩০-র মধ্যে। ধৃতদের বাড়ি বিহারের কাটিহার জেলার কোড়া থানার জোরারগঞ্জ গ্রামে। পুরুলিয়া শহরের গোশালা রাঘবপুর এলাকায় এদের ডেরা ছিল। বাকি সঙ্গীদের খোঁজ চলছে।”
ঘটনার সূত্রপাত বাঁকুড়ার খাতড়ায়। শনিবার দুপুরে ব্যাঙ্ক থেকে ৩৯ হাজার টাকা তুলে এক ভদ্রলোক বাড়ি ফিরছিলেন। মোটরবাইক আরোহী ওই দুই যুবক পিছন থেকে এসে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালায়। মুর্হূতেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। খাতড়া থানা পাশাপাশি ইঁদপুর, হিড়বাঁধ ও লাগোয়া পুরুলিয়ার পুঞ্চা থানায় ছিনতাইয়ের ঘটনা জানিয়ে দুষ্কৃতীদের ধরার জন্য অনুরোধ জানায়। থানাগুলি থেকে ফোন করে নজর রাখতে বলা হয়, ভিলেজ পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ারদের। তাঁদের সঙ্গে লোকজনও জড়ো হয়ে যায়। পুলিশ পিছু নিয়েছে বুঝতে পেরে দুই যুবক মরিয়া হয়ে পাকা রাস্তা ছেড়ে বাঁকুড়ার সীমানা পেরিয়ে পুরুলিয়ার পুঞ্চা এলাকায় ঢুকে পড়ে। এতেই বিপদ বাড়ে। রাস্তা জানা না থাকায় গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে ঢুকে পড়ায় পুলিশ ও বাসিন্দারা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেন। তার মধ্যেই জল-কাদায় দুর্ঘটনা।
পুঞ্চার ওসি ইসমাইল আলি বলেন, “ছিনতাইকারীরা এ দিকে আসছে খবর পেয়ে আমি পুঞ্চা থেকে বেরোনোর সমস্ত রাস্তায় পুলিশ, ভিলেজ পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ারদের মোতায়েন করে দিই। লাখরা গ্রাম দিয়ে আসছে জেনে নিজেও গাড়ি নিয়ে ওদের পিছু নিই।”
পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত কয়েকমাস ধরে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে মোটরবাইক নিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা পুলিশের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছিল। চেষ্টা করেও দলটাকে ধরা যাচ্ছিল না। শনিবার রাতেই দুই ছিনতাইকারীকে জেলার পুলিশ সুপারসহ পদস্থ আধিকারিকরা জেরা করেন। ওই দু’জনকে জেরায় পুলিশের কাছে দাবি করেছে, দলে তারা মোট ছ’জন রয়েছে। তারা কোথায়-কোথায় ছিনতাই করেছে তা জানার চেষ্টা চলছে। অনেক রাতে আটক করা মোটরবাইক-সহ দু’জনকে খাতড়া থানার পুলিশ নিয়ে যায়।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর মানবাজারের কেন্দ্রীয় আবাসিক ভবনের কলেজ পড়ুয়া সঙ্গীতা মণ্ডলের কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে নিয়ে আসার পথে একই ভাবে ছিনতাই হয়েছিল। এ দিন তিনি বলেন, “শুনেছি ওই দলটা না কি ধরা পড়েছে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা খোয়া যাওয়ায় আমি খুব সমস্যায় পড়েছি। ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।”