তিলপাড়া ব্যারাজেই নাব্যতা কমছে ময়ূরাক্ষীর

নীরবে মরছে নদী, হুঁশ নেই কারও

যে কালীগঙ্গায় ভেসে মৃতপ্রায় লালন সাঁই পৌঁছেছিলেন কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়, সেই কালীগঙ্গা নদী আজ আর বেঁচে নেই। জয়ন্তী, দড়াটানা, পাগলী, জলঙ্গি, ইছামতি, স্বরমঙ্গলা বাংলার এ রকম অসংখ্য নদী হয় হারিয়ে গিয়েছে, নয়তো বা মরতে বসেছে।

Advertisement

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার ও অরুণ মুখোপাধ্যায়

বীরভূম শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:০৯
Share:

নদী না জঞ্জালের স্তূপ, বোঝাই দায়। সাঁইথিয়ার গ্যাস গুদামের কাছে নদী ভরে উঠছে আবর্জনায়। ছবি: অনির্বাণ সেন।

যে কালীগঙ্গায় ভেসে মৃতপ্রায় লালন সাঁই পৌঁছেছিলেন কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়, সেই কালীগঙ্গা নদী আজ আর বেঁচে নেই। জয়ন্তী, দড়াটানা, পাগলী, জলঙ্গি, ইছামতি, স্বরমঙ্গলা বাংলার এ রকম অসংখ্য নদী হয় হারিয়ে গিয়েছে, নয়তো বা মরতে বসেছে। ওই সব নদী যেমন নাব্যতা, মাছ হারিয়েছে, তেমনই মানুষ হারিয়েছে কৃষিজমি-জীবন-জীবিকাও। ওই সব নদীর মতোই চোখের সামনে একটু একটু করে মরে যাচ্ছে বীরভূমের অন্যতম প্রাণভোমরা ময়ূরাক্ষী। নদী বিশেষজ্ঞদের মত, এই ‘মরে’ যাওয়ার পিছনে ভূতাত্ত্বিক কিছু কারণের চেয়ে ঢের বেশি দায়ী মানুষের ‘অবদান’ও।

Advertisement

একটা সময় এই ময়ূরাক্ষীর জলপথই ছিল জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। আজ সেই ভরা নদীই জায়গায় জায়গায় কার্যত ডোবায় পরিণত হয়েছে। নদীর প্রতি বিন্দুমাত্র খেয়াল না রেখেই ‘উন্নয়নে’র যুক্তিতে তৈরি হয়েছে অজস্র বাঁধ, সেতু, ঘাট এমনকী, নদীর বুক চিরে মোটা মোটা পাথর ফেলে তৈরি করা হয়েছে রাস্তাও। তার উপর রয়েছে বৈধ-অবৈধ যথেচ্ছ ভাবে বালি তোলা, এলাকার আবর্জনা অবলীলায় নদী গর্ভে নিক্ষেপ! যার নিট ফল ময়ূরাক্ষী আজ, শ্রীহীন এক নদীতে পরিণত হয়েছে।

অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, খোদ তিলপাড়া ব্যারাজেই দিন দিন কমছে ময়ূরাক্ষীর নাব্যতা। নদী গর্ভে জমে পাহাড় হওয়ার পলি বিপদ ডেকে আনছে বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুত্‌ কেন্দ্রেও। ওই কেন্দ্র জলের জন্য সব থেকে বেশি নির্ভর এই ব্যারাজের উপরেই। অথচ নদী সংস্কার নিয়ে কোনও চিন্তাভাবনা নেই। গঙ্গা বাঁচাতে কেন্দ্র সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ঘোষণা করেছে। কিন্তু এ দেশে ময়ূরাক্ষীর মতো যে কয়েকশো নদী মৃতপ্রায় অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, তাদের কে বাঁচাবে! উল্টো দিকে, এই সব নদীই প্রশাসনকে বছরভর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব দিয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

অথচ আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর আগেও এতটাও খারাপ অবস্থা ছিল না ময়ূরাক্ষীর। তখনও ভরা বর্ষায় এ নদী যে ভাবে চঞ্চল হয়ে উঠত, সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না। একসময় এই নদীকে কেন্দ্র করেই বীরভূমের সদর শহর সিউড়ি এবং বাণিজ্যকেন্দ্র সাঁইথিয়া গড়ে উঠেছিল। পাঁচ দশক আগেও এই নদীপথই ছিল জেলার বাণিজ্যের যাতায়াতের অন্যতম উপায়। সাঁইথিয়ার প্রবীণ বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তপন মুখোপাধ্যায় বলছেন, “ছোটবেলায় দেখেছি ময়ূরাক্ষীর জলপথে বড় বড় নৌকা চলছে। পণ্য বোঝাই ওই সব নৌকা আমদানি-রপ্তানির জন্য বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে। সে সময় নদীও খরস্রোতা ছিল।” কিন্তু পরে অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় নদী উপর দিয়ে বসে চলা সেই সব নৌকা কবেই হারিয়ে গিয়েছে। কয়েকটি বিশেষ জায়গা ছাড়া দেখা মেলে না জেলেদেরও। আগে নদীর সর্বত্রই যে সব মাছ পাওয়া যেত, আজ তার পরিমাণ বহুগুণ কমেছে। এমনকী, বহু পুরনো প্রজাতির মাছের দেখাই মেলে না। আবার এই নদীর জলের উপরেই নির্ভরশীল বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের কয়েক হাজার বিঘা জমির চাষ (বিশেষ করে বোরো ধান ও রবি শস্য)। যেখানে কোনও সরকারি জলপ্রকল্প পৌঁছয়নি, সেখানে পানীয় জলের জন্যও একটা বড় সংখ্যক গ্রামের মানুষ ময়ূরাক্ষীর উপরেই নির্ভর করে থাকেন। কিন্তু এই নদীর বর্তমান হাল, মানুষেরই দুর্দশা ডেকে আনছে।

বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গে নদী পরিকল্পনাগুলির মধ্যে ময়ূরাক্ষী প্রকল্প প্রথমে রূপায়িত হয়। ১৯৫১ সালে ওই প্রকল্পে সিউড়ির তিলপাড়ায় ময়ূরাক্ষী নদীর উপর এক হাজার ফুট দীর্ঘ একটি ব্যারাজ নির্মিত হয়। পরে ১৯৫৫ সালে কানাডার সাহায্যে ঝাড়খণ্ডের ম্যাসাঞ্জোড়ে ২,১৬০ ফুট দীর্ঘ উঁচু কানাডা বাঁধ নির্মিত হয়। ওই বাঁধের আড়ালে ২৬ বর্গ মাইল পরিমিত ৫ লক্ষ একর ফুট জল ধারণ ক্ষমতা-সহ একটি জলাধার গড়ে ওঠে। যার আবহ ক্ষেত্র ৭২০ বর্গ মাইল। কানাডা বাঁধে জল বের করার জন্য ২১টি গেট আছে। জলাধার থেকে ময়ূরাক্ষী নদীতে নেমে আসা জল ১,০১৩ ফুট দীর্ঘ তিলপাড়া ব্যারাজে আটকে শাখা-প্রশাখা যুক্ত ১,০৫০ মাইল দীর্ঘ সেচখাল পথে পাঠানো হয়। যার সাহায্যে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের ৫ লক্ষ ৫০ হাজার একর জমিতে সেচের জল দেওয়া হয়। সেচখালগুলি ছোট ছোট ব্যারাজের সাহায্যে ব্রাহ্মণী, দ্বারকা, বক্রেশ্বর ও কোপাই নদী অতিক্রম করে গিয়েছে দূরদূরান্তে। কিন্তু ঘটনা হল, ১৯৫১ সালের ২৯ জুলাই তত্‌কালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় তিলপাড়া ব্যারাজের উদ্বোধন করার পরে আজ পর্যন্ত ময়ূরাক্ষীর কোনও সংস্কার হয়নি।

সেই ময়ূরাক্ষীর উপরেই প্রতি দিন জায়গায় জায়গায় চলছে মানুষের মলত্যাগ। নোংরা-আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট েকানও ব্যবস্থা বিভিন্ন জায়গায় এখনও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে অবশ্য স্থানীয় বাসিন্দারা েমাটেই চিন্তিত নন। নদীকেই ডাস্টবিন হিসাবে বেছে নিয়েছেন ‘সচেতন’ বাসিন্দারা। কোথাও তো নদীর বুকে আবর্জনা ফেলছে পুরসভা-পঞ্চায়েতও। সাঁইথিয়া ফেরীঘাটের দক্ষিণ-পূর্ব পাড় দেখলেই তার প্রমাণ মেলে। নদীগর্ভে নোংরা আবর্জনা ফেলার পাশাপাশি বড় সমস্যা হল নদীকে ঘিরে অসংখ্য বালি তোলার ঘাট। যার জেরে যত্রতত্র নদীর বাঁধ কেটে নদীর উপর দিয়ে মাঝ নদী, কোথাও বা এ প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত বালি তোলার কাজ চলছে। কখনও তা বৈধ কাগজে, কখনও বা অবৈধ ভাবে দিনেদুপুরে বালি চুরি করে। এমনকী, সুবিধা মতো গাড়ি যাতায়াতের জন্য নদীর বুকে স্থায়ী রাস্তা গড়ে নদীর গতিপথকেই রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে! বর্তমানে সরু সুতোর মতো বয়ে চলা নদী মাঝে মধ্যেই পথ হারিয়ে থেমে গিয়েছে। যত্রতত্র বালি তোলার ফলে খাদগুলি কোথাও কোথাও পুকুরের চেহারা নিয়েছে। ওই সব গভীর খাদে পড়ে একাধিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

অথচ বিভিন্ন দেশেই নদীকে দূষণমুক্ত করা এবং আবর্জনা উদ্ধার নিয়ে নানা কর্মসূচির চল রয়েছে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার সাফল্যের সঙ্গে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব নদী দিবস’। যাকে উপলক্ষ করে নদীতে আনন্দবিহার, নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা প্রভৃতিও আয়োজন হচ্ছে। এ দেশে গঙ্গা ছাড়া আর কোনও নদীকে ঘিরে এমন কর্মকাণ্ড খুব একটা দেখা যায়নি। জেলাপরিষদের সভাধিপতি পদে বসার আগে বিকাশ রায়চৌধুরী জানিয়েছিলেন, ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে তিলপাড়ায় ময়ূরাক্ষী নদীর পলি সরানো হবে। এক বছরেও তার কিছুই হয়নি। বিকাশ অবশ্য এ ব্যাপারে প্রকল্পে থেকে প্রায় একশো কোটি টাকা বকেয়াকেই দায়ী করছেন।

ময়ূরাক্ষীর সংস্কার নিয়ে প্রশাসন কি কিছু ভাবছে? জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর বক্তব্য, “নদীর বুক থেকে বালি চুরি ঠেকাতে ইতিমধ্যেই সেচ দফতরকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি। ময়ূরাক্ষীর প্রকৃত অবস্থা দেখে সংস্কারের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করব।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement