নাজিরউদ্দিনের হাতে দলীয় পতাকা তুলে দিচ্ছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
পুরভোটের দল বদলেও তিনি রং পাল্টাননি। তাঁর নেতৃত্বেই দুবরাজপুর পুরভোটে ৪টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান পায় কংগ্রেস। দিন ক’য়েক আগেও দলের বীরভূম কেন্দ্রের প্রার্থীর হয়ে চাঁদি ফাটা রোদে তাঁকেই ঘুরতে দেখা গিয়েছে। পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সেই কাউন্সিলর নাজিরউদ্দিনই হঠাৎ যোগ দিলেন তৃণমূলে। তাঁরই সঙ্গে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে নাম লেখালেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শর্মিলা হলদারও। বুধবার বোলপুরে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের উপস্থিতিতে ওই দল বদলের পরে দুবরাজপুর পুরসভা কার্যত বিরোধীশূন্য হয়ে পড়ল। সকালে বোলপুরে দলীয় কার্যালয়ে দলবদল পর্বের পরে অনুব্রতর মন্তব্য, “উন্নয়নের স্বার্থেই ওদের কাউন্সিলরেরা আমাদের দলে এসেছেন। পুরসভার উন্নয়নে আমরা আরও শক্তিশালী হলাম। দুবরাজপুরে কংগ্রেস শেষ। এ বারের লোকসভার ভোটের প্রচার চালাতেও সঙ্গে লোক পাবে না কংগ্রেস।”
এ দিকে, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নাজিরুদ্দিন জানিয়েছেন, দলের উপর কোনও ক্ষোভ থেকে তিনি দলত্যাগ করেননি। বরং দল বদলের কারণ হিসেবে তিনি মুখে যা বলেছেন, তাতে পরোক্ষে তৃণমূল পরিচালিত দুবরাজপুর পুরসভার প্রতি পক্ষপাত মূলক আচরণেরই অভিযোগ উঠছে। দল বদল প্রসঙ্গে নাজিরউদ্দিনের প্রতিক্রিয়া, “আগের দল নিয়ে আমার কোনও ক্ষোভ নেই। কংগ্রেসই আমাকে পরিচিতি দিয়েছে। কিন্তু যাঁদের ভোটে জিতেছিলাম, সেই ওয়ার্ডবাসীদের জন্য যেটুকু করণীয় আমি করতে পারছিলাম না বলেই তৃণমূলে এলাম।” তা হলে কি শহরের উন্নয়নে রং দেখছে তৃণমূল পুরবোর্ড?
বাকি বিরোধী কাউন্সিলরেরা কিন্তু এমনটাই দাবি করছেন। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর আলাউদ্দিন খানের ক্ষোভ, “নেহাৎ নির্বাচন চলছে। না হলে আমার ওয়ার্ডে বঞ্চনার বিরুদ্ধে আমি পুরপ্রধানকে স্মারকলিপি দিতাম। তৃণমূল পুরবোর্ড পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। বিরোধী ওয়ার্ডগুলিতে কোনও উন্নয়নের কাজ করতে দিচ্ছে না।” এমন পরিস্থিতিতে ‘চাপে’ পড়েই নাজিরুদ্দিনরা শাসক দলে নাম লেখালেন বলে মনে করছে জেলার রাজনৈতিক মহল। পাশাপাশি পরপর সহকর্মীরা দল ছাড়াই এলাকায় ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া নাজিরুদ্দিনের কাছে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কংগ্রেস-ত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোনও পথও খোলা ছিল না বলেও তাঁদের মত।
তবে, বঞ্চনা নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ মানছেন না তৃণমূল পুরপ্রধান। পীযূষ পাণ্ডের দাবি, “উন্নয়ন বাবদ যে টাকা পুরসভায় বরাদ্দ হয়, তা প্রত্যেক কাউন্সিলরকে সমান ভাবেই ভাগ করে দেওয়া হয়। আবার কোনও বিশেষ প্রকল্পের টাকা বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে কে কোন দলের কাউন্সিলর তা দেখা হয় না। কিছু ওয়ার্ডে অনুন্নয়ন নিয়ে যে অভিযোগ উঠছে, তা-ও ঠিক নয়। ওখানে পুরবোর্ড সরাসরি উন্নয়নের কাজ করবে।” কিন্তু সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরকে এড়িয়ে করে এমন কাজ করা আদৌ উচিত কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাসিন্দাদের একাংশ।
গত পুরভোটে ১৬টির মধ্যে ৯টি আসন পেয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল তৃণমূল। সপ্তাহ কয়েক আগেও দলের দুই কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল কংগ্রেস। একে একে দলের টিকিটে জেতা সব কংগ্রেস কাউন্সিলরই দল বদল করায় বর্তমানে তৃণমূলের আসন ১৩। বিরোধী আসনে রয়েছেন বিজেপি-র দুই এবং সিপিএমের এক কাউন্সিলর। কিন্তু এ রকম একটা পরিস্থিতিতে তাঁরা কতটা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দিহান পুরবাসী। দুবরাজপুর পুরসভা কংগ্রেস-শূন্য হয়ে যাওয়ার পরে দলের পুরনো সঙ্গী নাজিরউদ্দিন সম্পর্কে কোনও কড়া কথা বলতে চাননি কংগ্রেসের জেলা সভাপতি তথা বীরভূম কেন্দ্রের প্রার্থী সৈয়দ সিরাজ জিম্মি। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “উনি যে উদ্দেশ্যে দল বদল করলেন, ঈশ্বর যেন তা পূরণ করেন। এর বেশি কিছু বলব না।” তবে, অনুব্রতর কটাক্ষ নিয়ে তিনি বলেন, “অনুব্রত এমন কথা অসংখ্য বার বলেছেন। ভোটের বৈতরণী পার করতে আমাদের যাত্রা-সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের প্রার্থী করতে হয় না। কে দুর্বল আর কে শক্তিশালী, ভোটের ফলের পরেই অনুব্রত তার উত্তর পেয়ে যাবেন।”
বিরোধী ওয়ার্ডে পক্ষপাতের ঘটনায় ক্ষুব্ধ ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফজলে শেখ, শালে মহম্মদ কিন্তু প্রশ্ন তুলছেন, “পুরপ্রধান কিন্তু কোনও বিশেষ ওয়ার্ড বা দলের নন। তিনি গোটা শহরের পুরপ্রধান। তাঁকে সব ওয়ার্ডের সমান উন্নয়নেই নজর দিতে হয়। আমাদের কাউন্সিলর বিরোধী দলের। তা বলে তিনি কেন পুরপ্রধানের থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবেন না?”