শুধু দুর্লভপুর নয়, রবিবার শাসকদল অবরোধ করে সিমলাপালেও।—নিজস্ব চিত্র।
বাঁকুড়া থেকে দুর্গাপুরে যাওয়ার প্রধান রাস্তা কয়েক সপ্তাহ ধরে বন্ধ। যে রাস্তা ভরসা, সেই মেজিয়া-রানিগঞ্জ ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক দলবল নিয়ে দেড় ঘণ্টা আটকে রাখলেন শাসলদলেরই সাংসদ ও বিধায়ক। চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়লেন যাত্রীরা। দলের মন্ত্রী মদন মিত্র প্রতারণার অভিযোগে ধরা পড়ায় রবিবারও পথ অবরোধ করে যাত্রীদের দুর্ভোগে ফেললেন তৃণমূল কর্মীরা।
গঙ্গাজলঘাটির গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দুর্লভপুর মোড়ে বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ ও শালতোড়ার বিধায়ক স্বপন বাউড়ির নেতৃত্বে অবরোধ চলে। আবার দক্ষিণ বাঁকুড়ার সিমলাপালে ব্লক তৃণমূল আধ ঘণ্টা বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়ক অবরোধ করেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে এ দিন জেলার দুই প্রান্তে এই অবরোধে হয়রানির একশেষ হলেন বাসিন্দারা।
বস্তুত শুক্রবার সিবিআই মদন মিত্রকে গ্রেফতার করার পরেই রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদে নামে তাঁর দল। শনিবার তা অবরোধ, মিছিল, সভায় বড় আকার নেয়। অবরোধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে হয়রান হন যাত্রীরা। এরপরেই শনিবার রাতে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় দলের কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ করুন, বিক্ষোভ-মিছিল করুন কিন্তু আবেগতাড়িত হয়ে রেল-রাস্তা অবরোধ করবেন না। সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা মাথায় রাখুন।”
কিন্তু তা শুনলে তো! রবিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাংসদ সৌমিত্র খাঁ, শালতোড়ার বিধায়ক স্বপন বাউরি, গঙ্গাজলঘাটি পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি জীতেন গড়াই-সহ স্থানীয় প্রায় ১২ জন ব্লক নেতা দলের কর্মীদের নিয়ে রাস্তা অবরোধ করেন। উল্লেখ্য, বড়জোড়ার শ্যামাপুর সেতু সংস্কারের কাজ চলায় দরুন বর্তমানে দুর্গাপুর ব্যারাজের উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঘুরপথে বাঁকুড়া-রানিগঞ্জ জাতীয় সড়কের উপর দিয়েই আসানসোল ও দুর্গাপুর যাওয়া আসা করছে বাঁকুড়ার বাস, লরি প্রভৃতি যানবাহন। ফলে বাঁকুড়া ও দুর্গাপুর-আসানসোল-রানিগঞ্জের মধ্যে যোগাযোগকারী একমাত্র প্রধান সড়ক প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েন মানুষজন। শুধু বাস বা যাত্রী নিয়ে যাওয়ার অন্যান্য গাড়িই নয়, শিল্পাঞ্চলের ট্রাক, লরিও আটকে যায়। দেড় ঘণ্টা অবরোধ চললেও জট কেটে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে যায়।
আটকে পড়া যাত্রীদের মধ্যে আসানসোলের এক বাসিন্দার ক্ষোভ, “তৃণমূল নেত্রী তো মুখে নিজেকে বন্ধ-অবরোধের বিরুদ্ধে বলেই ঘোষণা করতেন। কিন্তু তাঁর দলের জনপ্রতিনিধিদেরই কী কাণ্ড! আন্দোলন করতে হলে অনশনে বসুক। সাধারণ মানুষকে ভুগিয়ে কি লাভ?” ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে দুর্গাপুর থেকে বাঁকুড়ায় ফিরছিলেন দুর্গাপুরের বেনাচিতি এলাকার এক ব্যক্তি। তাঁর ক্ষোভ, “বাঁকুড়ায় এক ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিগত কাজে দেখা করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পথে এতক্ষণ আটকে পড়ায় সব কাজ ভেস্তে গেল।” কেউ কেউ দুর্গাপুর ও আসানসোলে ট্রেন ধরতে রওনা দিয়েছিলেন। তাঁরা ট্রেন পাবেন কি না তা নিয়ে আশঙ্কা করছিলেন। একজন তো বলেই বসলেন, “প্রতারণার অভিযোগে মন্ত্রী ধরা পড়ায় রাজ্যবাসী হিসেবে আমাদেরই তো মুখ পুড়ল। তারপরেও জোর করে রাস্তা আটকে ফের আমাদেরই ভোগান্তির মধ্যে ফেলা হল!” যাত্রীদের অভিযোগ, অবরোধের কাছে পুলিশকে দেখা গেলেও তাঁদের কার্যত হাত গুঁটিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। সিমলাপাল ব্লক তৃণমূল নেতা তথা জেলা পরিষদ সদস্য দিলীপ পণ্ডার নেতৃত্বে সিমলাপাল স্কুল মোড়ের কাছে বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়ক অবরোধ করা হয় বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ। চলে আধ ঘণ্টা। রাস্তার দু’দিকেই গাড়ির লম্বা লাইন পড়ে যায়। অবস্থা স্বাভাবিক হতে বেশ কিছু সময় লেগে যায়।
অবরোধের খবর পেয়ে দলের জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “অবরোধ করার জন্য কোনও নির্দেশ দেয়নি দল। জানি না কারা করেছে। খোঁজ নিয়ে দেখছি।” তা হলে কার নির্দেশে এই অবরোধে নামলেন জনপ্রতিনিধিরা? জানতে চাওয়া হলে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। সাংসদ সৌমিত্র খাঁকে ফোন করা হলে তিনি প্রথমে দাবি করেন, “আমি তো অবরোধ তুলতে গিয়েছিলাম।” আপনি তো বন্ধের সমর্থনে মাইক্রোফোনে বক্তব্যও রেখেছেন? তখন তিনি দাবি করেন, “ওটা তৃণমূলের নয়, সাধারণ লোকের অবরোধ ছিল। ওঁদের অনুরোধে দু’টো কথা বলেছি।” এরপরেই তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন। ফের ফোন করে বলেন, “তৃণমূলের লোকেরাই অবরোধ করেছিলেন, তাই সমর্থন জানাতে গিয়েছিলাম।” কিন্তু দলের তো অবরোধের নির্দেশ নেই? তখন জবাব, “তৃণমূলের উপর ষড়যন্ত্র হওয়ায় দলের কর্মীরা প্রতিবাদে নেমেছিলেন। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো আমার নৈতিক দায়িত্ব। তাই গিয়েছিলাম।”
তাহলে অবরোধ ডেকেছিলেন কে? শালতোড়ার বিধায়ক স্বপন বাউরি বলেন, “দলের কোনও নির্দেশ ছিল না ঠিকই। আবেগের বশে আমরা এই অবরোধ করেছি। তবে অবরোধ করার আগে সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েই পথ আটকানো শুরু করেছিলাম।” অবরোধে থাকা গঙ্গাজলঘাটি পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি জিতেন গড়াইয়ের দাবি, “আমাদের রাজ্যের ক্ষতি করছে বিজেপি, তাই মানুষের জন্যই এই অবরোধ করেছি।”
কিন্তু সাধারণ মানুষের এতে কী লাভ হল? উত্তরে জিতেনবাবু দাবি করেন, “১০ মিনিটের বেশি তো অবরোধ করা হয়নি।” তিনি ফোন কেটে দেন। বিজেপি-র জেলা মুখপাত্র অজয় ঘটকের অবশ্য কটাক্ষ, “অবরোধ-বন্ধ করে মানুষকে নাকাল করাই তৃণমূলের কাজ। এত বড় দুর্নীতির পরে ওদের আর ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়। অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি।”