জল নিয়ে কাড়াকাড়ি। বোলপুর এলাকায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
উত্স নির্দিষ্ট, কিন্তু খামতি নেই উপভোক্তার বৃদ্ধিতে!
ঠিক এই প্যাঁচে পড়েই পানীয় জল নিয়ে দুর্ভোগের অন্ত নেই বোলপুর পুরবাসীর। রাজনৈতিক নেতা থেকে জনপ্রতিনিধি, নানা আশ্বাসের পরেও দীর্ঘ কয়েক দশকে শহরবাসী সেই জল-সঙ্কটের চেহারায় তেমন কোনও পরিবর্তন দেখতে পাননি। বাম থেকে কংগ্রেস, কংগ্রেস থেকে তৃণমূল পুরসভার ক্ষমতায় বদলের পরেও সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। অথচ দিন যত এগিয়ে শহরের পরিধি ও জনসংখ্যা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। কিন্তু, সেই কয়েক দশক আগে তৈরি ‘ইন্দো-জার্মান জলপ্রকল্প’ ছাড়া প্রশাসন বাসিন্দাদের কিছু দিতে পারেনি।
ঘটনা হল, রাস্তাঘাট, নিকাশি ব্যবস্থা, নোংরা আবর্জনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, পাড়ায় পাড়ায় পথবাতি না জ্বালা-সহ একাধিক নাগরিক পরিষেবা নিয়ে অল্পবিস্তর ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েইছে। কিন্তু, ওই সব সমস্যাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা পানীয় জলের সঙ্কট। ফলে একটি আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র হয়েও গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা, রোজ দিন পানীয় জলের জন্য লড়ে যেতে হচ্ছে শহরবাসীকে। বাসিন্দাদের সেই লড়াই-ই আসন্ন পুরভোটে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে বলে রাজনৈতিক মহলের মত। পুরসভার ক্ষমতায় থাকা বর্তমান তৃণমূল বোর্ড অবশ্য এলাকায় জল-সঙ্কটের এই বাস্তবতার সঙ্গে একমত নয়। পুরপ্রধানের দাবি, সামান্য কিছু এলাকায় জলের অপ্রতুলতা থাকলেও শীঘ্রই সে সমস্যাও মিটে যাবে। বিরোধীরা তো বটেই, তাঁর ওই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই।
এই শহরের জল-সঙ্কটের ছবিটা ঠিক কেমন?
বোলপুর পুরসভার ২০টি ওয়ার্ডের (সদ্য একটি ওয়ার্ড বেড়েছে) মধ্যে একাধিক ওয়ার্ডে পানীয় জল সরবরাহ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের স্কুলবাগান এবং তার পাশের এলাকা, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জামবুনি, কালীমোহন পল্লি, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের গুরুপল্লি (দক্ষিণ ও পশ্চিম), ইন্দিরা পল্লি, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিম পাড়া, উত্তরপাডা মনসাতলা, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মিশন কম্পাউন্ড, রেল লাইনের এপার, ১ নম্বর ওয়ার্ডের মকরমপুর, লাইনের ওপার মোটামুটি ভাবে এই ক’টি অঞ্চলের মানুষের জলের দুর্ভোগ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, শীতকালে জলের সমস্যা সেই অর্থে বোঝা না গেলেও, গ্রীষ্ম পড়তে না পড়তেই সঙ্কট তীব্র হতে শুরু করে। সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরদের থেকে শুরু করে পুরপ্রধান, প্রত্যেকের কাছে বারবার অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি বলে তাঁদের দাবি। উপরন্তু সমস্যা আরও বেড়েছে। বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, ‘ইন্দো-জার্মান জলপ্রকল্পে’র জল সরবরাহ পুর কর্তৃপক্ষ দিনে তিন বার দিলেও পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। গতিও আশানুরূপ নয়। এক বালতি জল ভরতেই ৫-৭ মিনিট সময় লেগে যায়। রয়েছে জল ধরতে গিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঝামেলাও। স্থানীয় বাসিন্দা শেখ গোলাপ, নারায়ণ কোনাই, আশিস দত্তমজুমদার, আশিস চট্টোপাধ্যায়, আলো নস্কররা বলছেন, “এমনিতেই বাড়িতে পানীয় জলের জোগানে সমস্যা রয়েছে। তার উপর পাড়ার কলেও সেই এক সমস্যা। অথচ পুরসভা এত দিনেও জলের কোনও বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। অবিলম্বে সমস্যার সমাধান না হলে এই গ্রীস্মের বাকি দিনগুলিতে আমরা তীব্র জল-সঙ্কটে পড়ব।” একই অভিজ্ঞতা ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নির্মল দাস, মহম্মদ মহসিন, তপন কুণ্ডু, তুলসি ঘোষ, সমর দাসদেরও।
কেন এই জল-সঙ্কট?
বোলপুর এলাকায় পানীয় জলের এক মাত্র উত্স ‘ইন্দো-জার্মান জলপ্রকল্প’ কয়েক দশক আগে গড়ে উঠেছিল। তত্কালীন জনসংখ্যার ভিত্তিতেই তার পরিকাঠামো গড়া হয়েছিল। কিন্তু, যত দিন গিয়েছে বোলপুর শহর বহরে বেড়েছে। পুরনো এলাকা ছাড়াও বর্ধিত এলাকাগুলিতে সমান তালে জনবসতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে ওয়ার্ড সংখ্যাও। কিন্তু, এলাকাবাসীর জন্য আগের প্রকল্প ছাড়া পানীয় জলের অন্য কোনও উত্স তৈরি করতে পারেনি বোলপুর পুরসভা। ফলে স্বাভাবিক কারণেই সাধ্যের বাইরে গিয়ে ক্রমে বর্ধিত এলাকা এবং তার আরও বেড়ে চলা বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় জলের জোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ‘ইন্দো-জার্মান জলপ্রকল্প’। যার নিট ফল শহরবাসীর পানীয় জল নিয়ে সঙ্কট থেকে মুক্তি মেলার ক্ষেত্রে আপাতত কোনও দিশা নেই। মিশন কম্পাউন্ডের বাসিন্দা তথা শহরের প্রাক্তন পুরপ্রধান, কংগ্রেসের তপন সাহা বলছেন, “নব্বইয়ের দশকে প্রায় ৬৬ হাজার জনসংখ্যার জন্য ওই জলপ্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে পুর এলাকার জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লক্ষ। সেই অনুপাত মানুষের কাছে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা ওই প্রকল্পের নেই। তাই পানীয় জলের বিকল্প উত্স খুঁজতে হবে পুর কর্তৃপপক্ষকে। যা অনেক দিন আগেই করা দরকার ছিল।” তাঁরও অভিযোগ, এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বহুবার আবেদন জানিয়েও কোনও ফল মেলেনি।
কী বলছেন বিরোধীরা?
সিপিএমের দখলে থাকা ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর স্নেহময় গুড়িয়া এবং কংগ্রেসের দখলে থাকা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রদীপ পাঠকের অভিযোগ, “দিনকে দিন শহর বোলপুরে পানীয় জলের সমস্যা বাড়ছে। পুরপ্রধানকে এ নিয়ে বারবার জানানো হয়েছে। কিন্তু, তৃণমূল পুরবোর্ডের কোনও হেলদোল নেই। ফলে সমস্যার সমাধান তো দূর, সঙ্কট আরও বেড়েই চলেছে।”
যদিও শহরে পানীয় জল নিয়ে এই সমস্যার কথা মানছেন না তৃণমূল পুরপ্রধান সুশান্ত ভকত। তাঁর পাল্টা দাবি, “পানীয় জলের তেমন সঙ্কট নেই। কিছু এলাকায় জলের পরিমাণ কম থাকতে পারে। অস্বীকার করছি না। কিন্তু, তা বলে সঙ্কটের মতো কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।” গত গ্রীষ্মের মতো এ বারও তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে পানীয় জলের বিকল্প উত্সের জন্য ৩৮ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে অজয় নদ এবং কোপাই নদীতে দু’টি জলপ্রকল্পের আশ্বাসবাণী। কিন্তু, গত এক বছরেও পুরসভা তার কাজ শুরু করতে পারেনি। সুশান্তবাবুর যদিও দাবি, “ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের অনুদান পেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের সঙ্গে কথা হয়েছে। কাজ দ্রুত শুরু হচ্ছে।” পাশাপাশি ‘ইন্দো-জার্মান জলপ্রকল্পে’র দ্বিতীয় দফার কাজও শুরু হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন। তৃণমূল পুরবোর্ডের দাবি, সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী দিনে পানীয় জল সংক্রান্ত কোনও সমস্যাই থাকবে না বোলপুরে।