পারুলিয়ার জামথালিয়ায় চলছে কাজ।—নিজস্ব চিত্র।
বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা খরাপ্রবণ এলাকায় সেচ-সহ নানা দিকে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বহু দিন। ‘চেক ড্যাম’ তৈরি করে ছোট-বড় নালা বা কাঁদরের বয়ে যাওয়া জল ধরে রেখে ‘ওয়াটার শেড’ বা জলবিভাজিকা তৈরির ধারণা সেখান থেকেই। বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রকল্প ‘ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার শেড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে’র (সুসংহত জলবিভাজিকা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি) মাধ্যমে ওই সব পিছিয়ে পড়া এলাকার সার্বিক উন্নয়নে জোর দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। গত দু’বছর ধরে রাজ্যের যে ক’টি জেলায় সাফল্যের সঙ্গে ওই প্রকল্পের কাজ হচ্ছে, বীরভূম তার মধ্যে অন্যতম। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই সাতটি মুরারই, রাজনগর, ইলামবাজার ও দুবরাজপুরে মোট ৭টি সুসংহত জলবিভাজিকা প্রকল্পের কাজ চলছে। তার পরেও গোটা জেলায় আরও ১১টি এমন জলবিভাজিকা প্রকল্প গড়ে তোলার অনুমোদন পেয়ে গিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এই প্রকল্পের ব্যয়ের ৯০ শতাংশ টাকাই দেয় কেন্দ্র সরকার। বাকি ১০ শতাংশ রাজ্য। জেলা কৃষি উপঅধিকর্তা (মৃত্তিকা ও জল ব্যবস্থাপনা) তথা প্রকল্প অধিকর্তা আশিসকুমার বেরা বলেন, “সাতটি প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ৩৭ কোটি। অর্থাত্ এক-একটির জন্য গড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। কাজের সময় কাল পাঁচ বছর।”
কী ভাবে কাজ হবে?
প্রকল্প রূপায়ণের দয়িত্বে থাকবে একটি সংস্থা। সরকারি কোনও দফতর বা কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও হতে পারে। রাজ্যর অনুমোদন সাপেক্ষে তা ঠিক করবে জেলা কমিটি। দু’টি পর্যায়ে কাজ হবে। প্রথম পর্যায়টিকে বলা হচ্ছে ‘এন্ট্রি পয়েন্ট অ্যাক্টিভিটি’ (ইপিএ) বা প্রারম্ভিক কাজকর্ম। যে পর্যায়ে নির্বাচিত এলাকায় তাত্ক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা কী, তা জেনে নিয়ে পানীয় জলের নলকূপ সংস্কার, কুয়ো সংস্কার বা চাতাল বাঁধানো, পুকুর খনন বা সংস্কার করা হবে। এমনকী, স্বাস্থ্য শিবির, হাঁস মুরগির টিকাকরণের মতো নানা ধরনের কাজ দিয়ে এলাকার মানুষের আস্থাও আর্জন করা হবে। লক্ষ্য এটাই, এলাকার মানুষের ভালোর জন্যই এই কাজ হচ্ছে, তা বোঝানো। এর পরের ধাপে, ওই কাজে বরাদ্দ টাকা খরচের ‘ইউটিলাইজেশন সর্টিফিকেট’ জমা দিতে হবে। তা হলেই মূল পর্বের টাকা মিলবে। অবশ্য ঠিক কী কী ধরনের কাজ এলাকায় হতে চলেছে, তার বিস্তারিত সমীক্ষা রিপোর্টও জমা দিতে হবে। যে রিপোর্টে থাকবে— এলাকায় বসবাসকারী মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা, এলাকায় কত পরিমাণ জমি রয়েছে, তার মধ্যে কতটা সেচসেবিত, কত পরিমাণ জমিতে কোনও ভাবেই চাষ সম্ভব নয়, এলাকাবাসীর সার্বিক উন্নয়নে কী ধরনের পদক্ষেপ করা হবে, এমন নানা খুঁটিনাটি তথ্য।
প্রশাসন সূত্রের খবর, শুধু চেকড্যাম তৈরিই নয়, নির্ধারিত এলাকার পুকুর সংস্কার বা নতুন পুকুর খনন, সেচকুয়ো, সেচ নালাও ওই প্রকল্পে তৈরি করা হবে। যেখানে এলাকার মানুষ কৃষিকাজ করবেন, সঙ্গে মিলবে উপযুক্ত কৃষি পরামর্শও। এ ছাড়াও ভিন্ন পদ্ধতিতে চাষের প্রশিক্ষণ, জলাশয়ে মাছ চাষ, পুকুরপাড়ে গাছ লাগানো, হাঁস-মুরগি পালন, গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা, বাগান তৈরি প্রভৃতির প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো বিবিধ কাজও ওই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মধ্যেমে করা হবে। সেই সঙ্গে নির্ধারিত এলাকার মানুষকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ঋণ দিয়ে সহায়তাও করা হবে। এর জন্য ভূমি ও কৃষি-সেচ দফতরের সঙ্গে প্রাণিসম্পদ বিকাশ, মত্স্য, বন, মহিলা বিকাশ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প-সহ বিভিন্ন দফতরকে এই প্রকল্পের মধ্যে যুক্ত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, যে সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির কাজে খামতি রয়ে গিয়েছে, সে দিকে নজর রেখে পারস্পরিক আলোচনা সাপেক্ষে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
প্রকল্প রূপায়ণে দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয় রাখতে প্রতিটি দফতরের জেলা আধিকারিকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। জেলাশাসকক তার চেয়ারম্যান। আবার ব্লক পর্যায়ে বিডিও, এডিও, রেঞ্জার, বিএলডিও-র মতো কোনও আধিকারিককে প্রধান করে সংশ্লিষ্ট সব দফতরগুলিকে নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘ওয়াটার শেড ডেভলপমেন্ট কমিটি’। ব্লক স্তরের ওই কমিটিতে চুক্তি ভিত্তিক চার কর্মী (হিসাব রক্ষণ, জীববিদ্যা, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার) এবং পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির প্রতিনিধিরাও থাকবেন।
প্রকল্প অধিকর্তা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হওয়া চারটি প্রকল্পের সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। সামনের মাসেই সেগুলি জমা দেওয়া হবে। কাজের সুবিধার জন্য এক-একটি ওয়াটারশেড (৪০০০-৫০০০ হেক্টর) এলাকাকে একাধিক ছোট-ছোট (মাইক্রো) ওয়াটারশেডে বিভক্ত করা হবে। ওই এলাকায় বসবাসকরী সকলেই (জমি থাকুক আর না থাকুক) প্রকল্পের সদস্য। এলাকায় বসবাসকারীদের দু’ভাগে ভাগ করা হবে। এক উপভোক্তা গোষ্ঠী (যাঁদের এক একরের বেশি জমি রয়েছে) দুই স্বনির্ভর দল (যত বেশি সম্ভব গোষ্ঠী তৈরি করা হবে)। থাকবে এলাকাবাসীদের নিয়ে তৈরি একটি কমিটিও। আশিসবাবুর দাবি, “এখনও পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ভালই। সকলের সঙ্গে আলোচনা করেই প্রকল্পের কাজ এগোচ্ছে।”