অবরোধ তুলতে গ্রামবাসী ও ছাত্রদের বোঝাচ্ছে পুলিশ। খয়রাশোলে ছবিটি তুলেছেন দয়াল সেনগুপ্ত।
৭-০!
পরিবর্তনের জমানাতেও একচুলও বদলায়নি চিত্রটা। এক দিকে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের একের পর এক কলেজ দখল। উল্টো দিকে, কোথাও ভয় দেখিয়ে, কোথাও কলেজে ঢুকতে বাধা দিয়ে, কোথাও আবার ফর্ম কেড়ে নিয়ে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলিকে মনোনয়নপত্র তুলতে না দেওয়ার সেই বহু পুরনো অভিযোগ ওঠাও জারি রয়েছে। যার নিট ফল শুক্রবার জেলার সিউড়ি ও বোলপুর মহকুমার সাতটি কলেজের সব ক’টিই দখল করল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। যার মধ্যে দু’পক্ষের মধ্যে হিংসার ছবি দেখা গেল ইলামবাজার ও খয়রাশোল কলেজের মনোনয়নপত্র তোলাকে ঘিরে। এ ক্ষেত্রে কোনও কলেজেই বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই বা বিজেপি-র ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের মতো বিরোধী সংগঠনগুলি মনোনয়নপত্র তুলতে পারেনি।
এ দিনের গণ্ডগোলের জন্য অবশ্য পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকেই দুষছেন সংগঠনগুলির নেতারা। উল্টে তাঁদের অভিযোগ, পুলিশের পরোক্ষ মদতেই তৃণমূল এবং টিএমসিপি কলেজের সামনে বহিরাগতদের জড়ো করে মনোনয়নপত্র তোলায় বাধা দিয়েছে। যদিও এই দাবি মানতে নারাজ জেলার পুলিশ সুপার আলোক রাজোরিয়া। তাঁর পাল্টা দাবি, “একমাত্র ইলামবাজার কলেজ ছাড়া কোথাও তেমন বড় ধরনের গোলমাল হয়নি। ইলামবাজারে পুলিশ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেছে। অন্য জায়গাতেও পুলিশ সজাগ ছিল। যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা ভিত্তিহীন।” অন্য দিকে, হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম, খয়রাশোলের শৈলজা ফাল্গুনী মহাবিদ্যালেয়ের অধ্যক্ষ নিশিথনাথ চক্রবর্তীরা বলছেন, “কলেজ ক্যাম্পাসে কোনও ঝামেলা হয়নি। পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল।” আবার লাভপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গোকুল সাও, চণ্ডীদাস কলেজের অধ্যক্ষ নুরসাদ আলি, বোলপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাকির আলি এবং ইলামবাজার কবি জয়দেব মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহাদেব দেওয়াশীদের দাবি, “মনোনয়নপত্র তোলাকে কেন্দ্র করে কেউ কোনও অভিযোগ করেনি ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় পত্র দেখেই মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়েছে।”
যদিও বিরোধীদের অভিযোগ, গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের কায়দাতেই কলেজ ভোটেও সন্ত্রাস করে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলিকে মনোনয়নপত্র তুলতে বাধা দেওয়ার রণকৌশল নিয়েছে শাসক দলের তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। এ দিন সকাল থেকেই তার নমুনা মিলেছে ইলামবাজার কবি জয়দেব মহাবিদ্যালয়ে। সেখানে কলেজের বাইরে টিএমসিপি ও এবিভিপি-র কর্মী-সমর্থকেরা হাজির ছিলেন। তাঁদের হাতে দেখা গিয়েছে ইট, লাঠি, রড। বেলা ১২টা নাগাদ সিআই বোলপুর চন্দ্রশেখর দাস এবং ইলামবাজার থানার ওসি মহম্মদ আলির নেতৃত্বে কড়া পুলিশি প্রহরায় এবিভিপি-র প্রতিনিধিরা মনোনয়নপত্র তুলতে কলেজে ঢোকেন। ওই সময়েই উত্তেজিত তৃণমূল কর্মী-সমর্থক এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ইট, পাটকেল ছুড়তে শুরু করে বলে অভিযোগ। পুলিশ মৃদু লাঠি চার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এর পরেও অবশ্য এবিভিপি ওই কলেজে মনোনয়নপত্র জমা করতে পারেনি। বিজেপি-র ইলামবাজার ব্লক পর্যবেক্ষক চিত্তরঞ্জন সিংহের অভিযোগ, “তৃণমূল নেতা জাফারুল ইসলামের নেতৃত্বে দুষ্কৃতীরা আমাদের ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের তোলা মনোনয়নপত্র কেড়ে নেয়। পুলিশও পক্ষপাতিত্ব করেছে।” জাফারুল যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, “মিথ্যা অভিযোগ। আমি ওই সময় এলাকাতেই ছিলাম না!” এ দিন বোলপুর কলেজ থেকেও মনোনয়নপত্র তুলতে পারেনি এবিভিপি। প্রতিবাদে সংগঠন বোলপুরের মহকুমাশাসকের দফতরে বিক্ষোভ দেখায়।
অন্য দিকে, দুবরাজপুরের হেতমপুর ও খয়রাশোল কলেজেও এবিভিপি-কে মনোনয়নপত্র তুলতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বহিরাগতদের নিয়ে এসে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল, এমনকী গুলি ছোড়ারও অভিযোগ উঠেছে। এবিভিপি-র অভিযোগ, খয়রাশোল কলেজের ১২টি আসনের জন্যই সংগঠনের ছাত্র প্রতিনিধিরা মনোনয়নপত্র তুলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু, শাসকদলের বহিরাগতদের বাধায় তাঁরা মনোনয়নপত্রই তুলতে পারেননি। তৃতীয় বর্ষের দুই ছাত্র প্রতিনিধি গোপাল মুখোপাধ্যায় এবং সন্দীপ দাস মনোনয়নপত্র তুললেও বাইরে যেতেই তা কেড়ে নেওয়া হয় বলে এবিভিপি নেতৃত্বের দাবি। প্রতিবাদে তারা খয়রাশোল-বাবুইজোড় রাস্তা অবরোধ শুরু করেন। তবে, পুলিশ অবরোধ তুলে দেয়। অশান্তির আঁচ খয়রাশোল গ্রামেও পৌঁছে যায়। গ্রামবাসীদের একাংশের অভিযোগ, তৃণমূলের বহিরাগত দুষ্কৃতীরা কয়েক জন ছাত্রকে তাড়া করতে গিয়ে গ্রামেরই দু’জনের কানে পিস্তল ঠেকায়। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা তখন পথ অবরোধ করেন। এ বারও পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। একই চিত্র দেখা যায় হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজেও। মনোনয়নপত্র তুলতে না পেরে প্রতিবাদে পানাগড়-দুবরাজপুর ১৪ নম্বর রাজ্য সড়ক অবরোধ করে বিজেপি ও তাদের ছাত্র সংগঠন।
এবিভিপি-র জেলা সভাপতি রূপম মণ্ডলের অভিযোগ, “প্রতিটি কলেজেই আমরা প্রতিনিধি দেব বলে তৈরি ছিলাম। শাসক দলের সন্ত্রাসের জেরে তা সম্ভব হল না।” তাঁর দাবি, “লাভপুরে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বহিরাগত সশস্ত্রদের নিয়ে কলেজর সামনে জমায়েত করেছিল। আমরা সেখানে মনোনয়নপত্র তুলতে যেতে পারিনি। বোলপুর কলেজেও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ আমাদের মনোনয়নপত্র তুলতে দেয়নি। খয়রাশোল কলেজের সামনে থেকেই টিএমসিপি-র গুন্ডারা আমাদের কর্মীদের মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। ইলামবাজারে মনোনয়নপত্র কেড়ে নিয়েছে।” একই অভিযোগ করেছেন এসএফআই-এর জেলা সম্পাদক শতদল চট্টোপাধ্যায়ও। এ দিনই সন্ধ্যায় একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে সংগঠনের রাজ্য সভাপতি মধুজা সেনরায় এবং সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস দাবি করেছেন, “বীরভূমের কোনও কলেজে মনোনয়নপত্র তুলতে দেয়নি অনুব্রত মণ্ডলের শিক্ষায় শিক্ষিত এনারজেটিক ছাত্রনেতারা।” ইলামবাজার কলেজেও শাসক দলের ছাত্র সংগঠন তাদের বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ।
বিরোধী সংগঠনগুলির অভিযোগ মানতে চাননি টিএমসিপি জেলা সভাপতি সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, “একমাত্র মল্লারপুর কলেজে এসএফআই-এর কিছুটা জমি রয়েছে। সেটাও বোঝা যাবে শনিবার। আর এ জেলায় এবিভিপি-র আদৌ কোনও ছাত্র সংগঠন আছে বলে আমি মনে করি না। তাই বাধা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।” সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলি প্রার্থী না পেয়ে মনোনয়নপত্র তুলতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করছে বলে সুরঞ্জনবাবুর দাবি।