অপেক্ষা শেষ, কঠোর সাজা চান নির্যাতিতা

রায় শুনে একপক্ষ কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু হাসার জন্যই কোনও পক্ষ ছিলেন না। শুক্রবার লাভপুর গণধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণার পরে আদালত চত্বরে এমন দৃশ্যই ধরা পড়ল। এক দিকে দোষী সাব্যস্তদের পরিবারের সদস্যেরা হতাশ আর ক্ষুব্ধ। উল্টো দিকে গণধর্ষিতা মেয়েটির জন্য উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কেউ ছিল না। নির্যাতিতার দাবি, পুলিশ অথবা প্রশাসন, কোনও পক্ষ থেকেই এ দিনের রায় ঘোষণার কথা আগাম জানানো হয়নি। আগে জানলে, অবশ্যই তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যেরা ছুটে আসতেন এজলাসে।

Advertisement

মহেন্দ্র জেনা

বোলপুর শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৪০
Share:

বোলপুর আদালতে দোষীসাব্যস্তরা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

রায় শুনে একপক্ষ কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু হাসার জন্যই কোনও পক্ষ ছিলেন না।

Advertisement

শুক্রবার লাভপুর গণধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণার পরে আদালত চত্বরে এমন দৃশ্যই ধরা পড়ল। এক দিকে দোষী সাব্যস্তদের পরিবারের সদস্যেরা হতাশ আর ক্ষুব্ধ। উল্টো দিকে গণধর্ষিতা মেয়েটির জন্য উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কেউ ছিল না। নির্যাতিতার দাবি, পুলিশ অথবা প্রশাসন, কোনও পক্ষ থেকেই এ দিনের রায় ঘোষণার কথা আগাম জানানো হয়নি। আগে জানলে, অবশ্যই তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যেরা ছুটে আসতেন এজলাসে। অন্য দিকে, এ দিনই সুবলপুর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে টালিপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নির্যাতিতার জন্য প্রশাসনের বানিয়ে দেওয়া বাড়িতে সপরিবারে রয়েছেন তাঁর তিন ভাই। তাঁরাও বলেন, “রায়ের খবরটা আপনাদের কাছেই শুনলাম। আমরা দোষীদের যাবজ্জীবন সাজা চাই।”

লাভপুর গণধর্ষণ কাণ্ডের রায়দান হবে শুনে এ দিন সকাল থেকেই বোলপুর আদালত চত্বরে ভিড় জমছিল। বেলা বাড়তে তার সংখ্যা আরও বাড়ছিল। দ্বিতীয়ার্ধ্বে অতিরিক্ত জেলা জজ সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরীর এজলাসে শুরু হয় রায়দান। দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ একে একে ১৩ জন অভিযুক্তকে হাজির করানো হয়। আদালত কক্ষে জানালার বাইরে তখন অভিযুক্তদের পরিজন। ভাবলেশহীন ভাবে মাঝি-হাড়াম বলাই মণ্ডল-সহ ১৩ জনই হাতজোড় করে বিচারকের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিচারক অভিযুক্তদের দিকে তাকিয়ে নাম ধরে ধরে হাজির কি না জানতে চান। একে একে হাত তুলে প্রত্যেকে হাজিরা দেন। প্রথমেই বিচারক জানিয়ে দেন, লাভপুর সুবলপুর গ্রামের ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ১৩ জনের বিরুদ্ধেই তিনটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তাই সকলকেই দোষী সাব্যস্ত করে তিনি ভারতীয় দণ্ডবিধির ওই তিনটি ধারার কথা উল্লেখ করেন। এক একটি ধারা অনুযায়ী দোষীদের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সাজা কী হতে পারে, তা স্পষ্ট করে দেন। গণধর্ষণের জন্য সর্বনিম্ন ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা। যাবজ্জীবন মানে ‘আমৃত্যু’ কারাদণ্ডের বিষয়টি বিচারক আলাদা করে উল্লেখ করেন। এর পরেই তাদের উদ্দেশ্যে বিচারক জানান, আজ শনিবার শাস্তি সম্পর্কে দোষীরা নিজেদের কথা জানানোর পরেই সাজা ঘোষণা করা হবে। বিচারকের কথা শেষ হতেই মুখে কিছু না বললেও দোষীরা কার্যত দুমড়ে মুচড়ে যান। তাদের আদালতের বাইরে নিয়ে আসে পুলিশ। রায় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, বলাই ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকেন। অন্যেরাও কোনও উত্তর দেননি।

Advertisement

পরে সরকারি আইনজীবী মহম্মদ সামসুজ্জোহা জানান, গত ২০ জানুয়ারি বীরভূমের লাভপুর থানার সুবলপুর গ্রামে ভিন্ জাতের এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে রাখার ‘অপরাধে’ তরুণী ও তাঁর সঙ্গীকে রাতভর গাছে বেঁধে মারধর করা হয়। পরের দিন সালিশি বসিয়ে দু’জনকে জরিমানা করা হয়। দু’জনের মুক্তিপণ বাবদ সালিশি সভা তিন লক্ষ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। অভিযোগ ছিল, তরুণীর পরিবার সেই টাকা দিতে না পারায় গ্রামের মাঝি-হাড়াম বলাই মাড্ডি কয়েক জন যুবকের উদ্দেশ্যে মেয়েটিকে নিয়ে ‘ফূর্তি’ করার নিদান দেন। ওই রাতেই অভিযুক্তেরা তরুণীকে গণধর্ষণ করে। ঘটনার কথা প্রকাশ্যে এলে তাঁকে খুন এবং গ্রামছাড়া করার হুমকিও দেওয়া হয়। ২২ জানুয়ারি সকালে তরুণী অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফেরেন। সন্ধ্যায় লাভপুর থানায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। রাতেই পুলিশ বলাই মাড্ডি-সহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করে।

খবর পাওয়ার পরেই এ দিন দুপুরে দোষী সাব্যস্তদের পরিবারের লোকেরা সুবলপুর গ্রামের কলতলায় ভিড় জমান। গ্রামের মাঝি-হাড়াম বলাই মাড্ডির মা পাকু মাড্ডির দাবি, “ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছে।” তাঁরই সঙ্গে সহমত হয়ে অন্যতম দোষী সাব্যস্ত বালু টুডুর তরুণী মেয়ে পণ্ডি টুড, হেনা মাড্ডিদেরও (তাঁর দুই ছেলে মদন মাড্ডি, চানা মাড্ডি এবং নাতি সুরেশ মাড্ডি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন) এক দাবি করেন। অন্য দিকে, এ দিকে সকাল থেকে রায় শোনার জন্য একাধিক অভিযুক্তের পরিবারের সদস্যেরা আদালত চত্বরে উপস্থিত হয়েছিলেন। রায় ঘোষণার আগে তেরো জনের অন্যতম লাভপুর থানার রাজারামপুরের বাসিন্দা দেবরাজ মণ্ডলের দিদি কানন মণ্ডল বললেন, “আমার ভাই নির্দোষ। ও কিছু করেনি। বিচার ব্যবস্থার উপর আমার ভরসা আছে। ন্যায় বিচার পাবো।” রায় শোনার পরে অবশ্য প্রত্যেকেই ভেঙে পড়েন। দোষীদের পরিজন সুখী মাড্ডি, সুমি মাড্ডি, লক্ষ্মী টুডু, রিনা মাড্ডিরাই বিচারকের রায় শোনার পর থেকে আদালত চত্বরে সমানে কেঁদেই চললেন। কেউ-ই বিচারকের এই রায়ে সন্তুষ্ট নন। সনাতন মুর্মু, সুনীল মুর্মু, বোধন টুডুদের দাবি, “নির্দোষরা ফেঁসে গেল। গরিব দিন আনি দিন খাই মানুষগুলো সাজা পেল। তবে আদালতের উপরে ভরসা আছে।” প্রত্যেকেই জানালেন ন্যায় বিচার পেতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবেন।

প্রিয়জনদের প্রিজন ভ্যানে নিয়ে চলে যাওয়ার সময়ও কান্না থামছিল না লক্ষ্মী, সুমি, সুখীদের। অন্য দিকে, সিউড়ির হোমে দিন কাটানো নির্যাতিতা বলছেন, “সত্যের জয় হল। ওরা আমার উপর রাতভর অত্যাচার চালিয়েছিল। কতবার হাতজোড় করে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছিলাম। আমার বাবা-কাকা-ভাইয়ের বয়সী ওই পশুগুলোর কঠোর সাজা হোক।”

(সহ-প্রতিবেদন: অর্ঘ্য ঘোষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement