পুরুলিয়ার হুড়ার লালপুরে বাসের ছাদে উপচে পড়ছে ভিড়।
ঠায় দাঁড়িয়ে
সকালে ঝাড়খণ্ডের চাষ থেকে পরিবার নিয়ে পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ডে এসে নামতেই বিপত্তি শুরু হাবিবুল আনসারির। যাবেন পুরুলিয়া ১ ব্লকের দামদায়। কিন্তু বাসের দেখা নেই। বললেন, ‘‘আজ যে মিটিং আছে জানতাম না। কী মুশকিলে পড়লাম।’’
হুড়ার লালপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন লক্ষ্মণপুরের প্রৌঢ়া দীপালি কুম্ভকার। আসানসোল থেকে ট্রেনে, অটোতে কোনও রকমে ওই পর্যন্ত এসে থমকে গিয়েছেন। বাস নেই। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তৃণমূলকর্মী। এসে দীপালিদেবীকে বললেন, ‘‘বাস কম জানেনই তো। একটু দেখুন। না হলে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে।’’
জেলা বাস মালিক সমিতি সূত্রে জানানো হয়েছে, এ বারে সভার জন্য প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টিটি বাস নিয়েছে তৃণমূল। তবে মানবাজার, বরাবাজার, বান্দোয়ান এলাকা থেকেই বাস গিয়েছে। বাকি রুটগুলিতে পরিষেবা মোটের উপর স্বাভাবিক ছিল বলে সমিতির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
একই ছবি দেখা গিয়েছে বাঁকুড়াতেও। ব্যবসায়ী কমল সর্দার প্রায় ঘণ্টা দুয়েক দাঁড়িয়েছিলেন রানিবাঁধ বাসস্ট্যান্ডে। কোনও বাসেই উঠতে না পেরে শেষে বাড়ির পথ ধরেছেন তিনি। বাস কম থাকায় ট্রেনগুলিও ছিল ভিড়ে ঠাসা। বাঁকুড়ার জেলা শাসক মৌমিতা গোদারা বসু অবশ্য বলেন, “পরিবহনে সমস্যা নিয়ে আমার কাছে এ দিন কোনও অভিযোগ আসেনি।”
পোয়াবারো
রুটের অনেক বাস গিয়েছে কলকাতার সভায়। সকালে সরকারি বাসও বিশেষ চোখে পড়েনি। তবে বিষ্ণুপুরের রাস্তায় এ দিন নেমেছিল অনেক ছোট গাড়ি। মওকা বুঝে ভাড়াও বেশ চড়া হয়েছে। বিষ্ণুপুর থেকে কোতুলপুর যাওয়ার বাস ভাড়া কমবেশি ৩০টাকা। অফিসের সময় ছোটগাড়িগুলি সেই পথ যেতে ১৫০ টাকার কমে দর হাঁকেনি।
বিষ্ণুপুর-সোনামুখী রুটে কোনও সরকারি বাস নেই। ওই রাস্তায় যে সমস্ত স্কুল রয়েছে তার শিক্ষক শিক্ষিকারাও এ দিন যাতায়াতের সময় নাকাল হয়েছেন। অনেক দরদস্তুর করেও লাভ না হওয়ায়, চড়া ভাড়ায় রাজি হয়ে গাড়িতে উঠে এক শিক্ষক বলেন, ‘‘কারও পৌষমাস, কারও সর্বনাশ।’’
বিষ্ণুপুরে ভাল চাহিদা ছিল ভ্যানোরও। বাসস্টান্ডের কাছে ভ্যানো থেকে নেমে এক অফিসযাত্রী চালকের ফোন নম্বর টুকে রাখলেন ডায়েরিতে। বললেন, ‘‘ফেরার পথে কী অবস্থা হয় তা তো বলা যায় না। কাজে লাগতে পারে।’’
বাসের ছাদে
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে এক-আধটা বাস এলেও সেগুলির পাদানিতেও প্রায় দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। বাধ্য হয়ে অনেকেই এ দিন বাসের ছাদে উঠতে হয়েছে। বাঁকুড়ার পোয়াবাগান বাসস্টপে প্রায় আড়াই ঘণ্টা দাঁড়ানোর পরে বৃষ্টি মাথায় করে বাসের ছাদে উঠেছেন খাতড়ার হরেকৃষ্ণ গড়াই।
বেলা সওয়া এগারোটার সময় হুড়ার লালপুর মোড়ে দাঁড়িয়েছিলেন হিজলি গ্রামের মনিরুজ্জামান আনসারি। জানালেন, পুরুলিয়ায় ফিজিওথেরাপি করতে নিয়মিত যেতে হয় তাঁকে। অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পরে একটা বাস এল। তাতে ঠাসা ভিড়। অসুস্থতা ভুলে বাসের ছাদে উঠতে উঠতে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘‘কী আর করা যাবে! উপায় তো নেই।’’
অর্ধেক কাজ
শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফাল্গুনী মাহাতো পুরুলিয়া পুরসভায় এসেছিলেন ওবিসি শংসাপত্রের জন্য। ফেরার পথে জানালেন, অর্ধেক কাজ হয়েছে। তারপরে নিজেই খোলসা করে বলেন, ‘‘দু’জন কাউন্সিলরের সই লাগতো। এক জনকে পেলাম।’’ পুরসভায় এ দিন ছিল প্রায় ছুটির মেজাজ। অধিকাংশ কাউন্সিরলরই শহীদ দিবসের সভায় কলকাতা গিয়েছিলেন। ফলে গাড়ির সমস্যা সত্বেও যাঁরা পুরসভায় এসেছিলেন তাঁদের অনেকেরই কাজ হয়নি। এক পুরকর্মীকে বলতে শোনা গেল, ‘‘বুঝতেই তো পারছেন আজকের দিনটা...! কাল আসুন, কাজ হয়ে যাবে।’’
বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনিক ভবন এবং আদালত চত্বরে এ দিন ভিড় কিছুটা কম চোখে পড়েছে। তবে জেলা শাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, “দফতরের কর্মীদের হাজিরা ঠিকই ছিল।’’ প্রশাসনিক আধিকারিকদের অনেকেই অবশ্য দাবি করেছেন, ভূমি ও ভূমি সংস্কার এবং রেজিস্ট্রি অফিসের অনেক কর্মীই যানবাহনের সমস্যার জন্য আসতে পারেননি।
রেশ বাজারেও
কলকাতার সভার প্রভাব পড়েছে বাঁকুড়ার বাজারেও। বৃহস্পতিবার সকালে বড়জোড়ার বিজয়া ময়দান বাজারের ছবিটা অন্য দিনের তুলনায় আলাদা ছিল। অন্য দিনের তুলনায় কম বিক্রেতা পসরা নিয়ে বসেছিলেন। রোজ লাগোয়া গ্রামগুলি থেকে বেশ কিছু চাষি সব্জি নিয়ে বাজারে আসেন। টাটকা সব্জি। দামও বেশ কিছুটা কম। এ দিন ওই চাষিদের অনেকেই আসেননি। যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা জানান, সব্জি আনার মত পিক আপ ভ্যানের আকাল দেখা গিয়েছে এ দিন। সভার জন্য বাসের পাশাপাশি পিক আপ ভ্যানও তুলে নেওয়াতেই এই বিপত্তি।
অন্য দিকে, কলকাতার সভায় যাওয়া গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিষ্ণুপুরে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের কাছে বাইপাসের উপর পণ্যবাহী ট্রাক আটকে রাখা হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল ওড়িশা থেকে মাছ বা খড়্গপুর থেকে ফল নিয়ে আসা ট্রাকও।
বন্ধ না কি!
জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা কাজে আসা মানুষের ভিড়ে অন্য দিন গমগম করে বাঁকুড়া শহর। এ দিন ছবিটা ছিল অন্য রকম। শহরের রাস্তায় ভিড় ছিল অনেক কম। কলেজ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক টোটো চালক বলেন, ‘‘সকাল থেকে একটা ভাড়াও হয়নি। শহরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বন্ধ চলছে।’’
সেকেন্ড ইনিংস
ক্রিকেট বা ফুলবল ম্যাচ থাকলে টিভির দোকানে ভিড় জমান অনেকে। পুরুলিয়া শহরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এলাকার একটি টিভির দোকানে এ দিন সকাল থেকেই এক সঙ্গে সব ক’টি টিভি সেটে খবরের চ্যানেল চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভিড়ও জমেছিল দোকানের বাইরে। এক দর্শকের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে হঠাৎ। কানে ফোন দিয়ে বলেন, ‘‘দাঁড়ান মশাই, সেকেন্ড ইনিংসে দিদির কী বলেন আগে শুনি। পরে ফোন করছি।’’
একলা চলো
এলাকার অন্য নেতাদের সঙ্গে বনিবনা বিশেষ নেই। এমনকী অনেক দিন ধরে কথাবার্তাও বন্ধ। বুধবার রাতে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে একের পর এক বাস চলে গিয়েছে কলকাতার সভায়। তাঁকে কেউ ডাকেনি। এই পরিস্থিতিতে, মানবাজারের পঞ্চায়েত সদস্যার স্বামী ওই নেতার কাছে অনুগামীরা এসে অনুযোগ করেছেন, তাঁরা কি ফেলনা! দাবি করেছেন, যতই খরচ হোক, সভায় যেতেই হবে। যেমন কথা তেমন কাজ। বৃহস্পতিবার কাকভোরে ছোট গাড়ি ভাড়া করে, দলের পতাকা লাগিয়ে, স্লোগানে পাড়া কাঁপিয়ে তাঁরাও রওনা দিলেন কলকাতার পথে।
তথ্য: প্রশান্ত পাল, সমীর দত্ত, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবব্রত দাস ও রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবিগুলি তুলেছেন শুভ্র মিত্র, সুজিত মাহাতো, অভিজিৎ সিংহ এবং প্রদীপ মাহাতো।