ভোটের মুখে জলের কাঁটাও তৃণমূলে

পুরুলিয়ায় যখন জলের আকালকে ঘিরে পুরভোট সরগরম হয়ে উঠেছে, পাশের জেলা বাঁকুড়াতেও সেই সমস্যার আঁচ পড়েছে ভোটের মুখে। পুরুলিয়া শহরে ইতিমধ্যেই জলের দাবিতে দফায় দফায় পথ অবরোধ করেছেন এলাকাবাসী। বাঁকুড়ায় এখনও পথে নেমে আন্দোলন গড়ে না তুললেও গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে চলতে থাকা জলসঙ্কটে ফুঁসছেন এই পুর-শহরের বাসিন্দারাও। পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েকটি ওয়ার্ডে জলগাড়িও পাঠাচ্ছে পুরসভা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৩৬
Share:

ভোট আসে। কিন্তু ছবিটা বদলায় না। গরমে কলে জল মেলে না। বাঁকুড়াবাসীর ভরসা তাই পুরসভার জলের গাড়ি। আর এই জল সমস্যাকে হাতিয়ার করেই বৃহস্পতিবার প্রচারে নেমে মানুষকে জল খাওয়ালেন বিজেপির প্রার্থী মৌমিতা সেন বাউরি ও মণিকা দত্ত।—নিজস্ব চিত্র

পুরুলিয়ায় যখন জলের আকালকে ঘিরে পুরভোট সরগরম হয়ে উঠেছে, পাশের জেলা বাঁকুড়াতেও সেই সমস্যার আঁচ পড়েছে ভোটের মুখে। পুরুলিয়া শহরে ইতিমধ্যেই জলের দাবিতে দফায় দফায় পথ অবরোধ করেছেন এলাকাবাসী। বাঁকুড়ায় এখনও পথে নেমে আন্দোলন গড়ে না তুললেও গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে চলতে থাকা জলসঙ্কটে ফুঁসছেন এই পুর-শহরের বাসিন্দারাও। পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েকটি ওয়ার্ডে জলগাড়িও পাঠাচ্ছে পুরসভা। তাতে অবশ্য পুরবাসীর ক্ষোভ মিটছে না। শুধু গোঁজ কাঁটা নয়, জল-সঙ্কটের কাঁটাও এ বার শাসকদলকে বিঁধছে।

Advertisement

বস্তুত, সুখা জেলা হিসেবে পরিচিত লালমাটির বাঁকুড়া জেলায় জলকষ্ট নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা কোনও বিষয় নয়। ফি-বছরই গ্রীষ্মে জলস্তর নীচে নেমে গিয়ে জলকষ্টে ভোগে জেলার অধিকাংশ ব্লকই। পুরশহর বাঁকুড়াও ব্যতিক্রম নয়। তবে চলতি বছরে গরম শুরু হওয়ার আগেই পুরসভার জল পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। শহরের ১১, ২১, ২৩, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডগুলিতে পুরসভার টাইম কলে জলই দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ। আবার অন্য ওয়ার্ডগুলিতেও খুবই কম সময়ের জন্য জল দেওয়া হচ্ছে। তা-ও জল আসার নির্দিষ্ট সময় নেই। ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, দিনের শেষে মাঝরাতেও ২০-২৫ মিনিটের জন্য কলে জল আসতে দেখা যাচ্ছে। ফলে তাঁরা তখন জলই তুলতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে কিছু ওয়ার্ডে পানীয় জলের ট্যাঙ্ক পাঠাচ্ছে পুরসভা। তবে, এক দিন ছাড়া ছাড়া। পুর-এলাকার অধিকাংশ টিউবওয়েলের জলও শুকিয়ে গিয়েছে। অনেক কল আবার অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। কুয়োর জলস্তর নীচে নেমে গিয়েছে। সব মিলিয়ে চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকেই জলের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে বাঁকুড়া পুরসভায়। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরের নলকূপ থেকে জল মিলছে না। জলছত্রগুলিতেও জল নেই। ফলে সমস্যায় পড়ছেন রোগীর আত্মীয়েরাও।

১১ নম্বর ওয়ার্ডের নতুনচটি এলাকার বধূ ঝুমা রুইদাস, সুমিত্রা রুইদাসদের ক্ষোভ, ‘‘আমাদের এলাকায় কলে জল দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে সাত দিন হল। অথচ খাওয়ার বা স্নান করার জন্য আমরা ওই জলের উপরেই নির্ভরশীল। একে গরম, তার উপরে জল নেই। দু’বার মাত্র পুরসভার জলের ট্যাঙ্ক এসেছে। কী ভাবে যে দিন কাটছে আমরাই জানি।’’ শহরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কালীতলা এলাকার বাসিন্দা পুতুল দাসের কথায়, ‘‘কলে জল একেবারে আসছে না, তা নয়। তবে জল ২০-২৫ মিনিটের বেশি থাকছে না। জল পড়ছে সরু হয়ে। জল আসার নির্দিষ্ট কোনও সময়ও নেই। কখনও মাঝরাতে, কখনও দুপুর ২টোর পরে জল আসছে।’’

Advertisement

জলের সমস্যার জন্য তৃণমূলকেই এক হাত নিচ্ছে বিরোধীরা। পরিকল্পনা মাফিক পুরসভা না চালানোতেই পুরবাসীকে এখনই জলের জন্য হাহাকার করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী সিপিএম কাউন্সিলর স্বরূপ সেন। তাঁর ক্ষোভ, “তৃণমূলের পুরবোর্ডে চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল (সিআইসি) না থাকায় পুরসভায় জলসরবরাহ বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে। জলসঙ্কট মেটাতে নতুন করে কোনও চিন্তাভাবনাই করা হয়নি বিগত কয়েক বছর।’’ তাঁর দাবি, বাম আমলে পরিকল্পিত ভাবে সমস্যাটিকে মেটানো হত। জলকল বিভাগ নদী গর্ভে কুয়ো কেটে জল ধরে রাখত। নদীর জল শুকিয়ে যাওয়ার আগেই কংসাবতী থেকে জল ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হত। স্বরূপবাবুর অভিযোগ, “এ বার কোনও কিছুই করা হয়নি। তার জন্যই পুরবাসীকে কষ্টের মধ্যে পড়তে হচ্ছে।’’ একই ভাবে বাঁকুড়া পুরসভাকে এক হাত নিয়েছেন এই শহরের বাসিন্দা তথা বিজেপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার। তিনিও পুরসভার পরিকল্পনায় গাফিলতির কথাই তুলে ধরেছেন। সুভাষবাবু বলেন, “বাড়িতে বাড়িতে সাব-মার্সিবল। মাটির তলার জল যথেচ্ছ ভাবে তুলছি আমরা। কিন্তু, জল ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনাই নেই। এই পুরসভার কটা বাড়িতে রেন-ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম (বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা) আছে তার উত্তর দিতে পারবে পুরসভা? বিগত পাঁচ বছরে কটা পুকুর সংস্কার হয়েছে, তার তথ্য তুলে ধরুক শাসক দল।’’ জলের সমস্যা মেটাতে অবিলম্বে বড় জলাশয় খননের দাবি তুলেছেন তিনি। পাশাপাশি বৃষ্টির জল যাতে কোনও ভাবেই নষ্ট না হয়, তার জন্য পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন বাঁকুড়া পুরবাসীর কাছে।

জলসঙ্কটকে যে এ বার ভোটের প্রচারে হাতিয়ার করবে বিরোধী দল, তার আঁচ আগেই পেয়েছে শাসক দল। সম্প্রতি বাঁকুড়ায় কর্মিসভা করতে এসে জলসমস্যা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়লে দলীয় কর্মীদের দামোদর নদ থেকে পানীয় জল নিয়ে আসার প্রকল্পের কথা বলার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন তৃণমূলের সাংসদ তথা জেলা পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী। তবে ‘জলসমস্যা মেটাতে পুরসভা কোনও পদক্ষেপ নেয়নি’- বলে যে অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা তার উত্তর কি, জানতে চাওয়া হলে বাঁকুড়া পুরসভার বিদায়ী পুরপ্রধান শম্পা দরিপা বলেন, ‘‘বামেরা যদি সুষ্ঠু ভাবে জল-সমস্যার সমাধান করেই থাকেন, তা হলে আজ এই অবস্থা কেন?’’ তাঁর দাবি, ‘‘গত পাঁচ বছরে শহরে পানীয় জলের সঙ্কট সে ভাবে ছিল না। গত বছর কম বর্ষা হওয়ায় জলস্তর নীচে নেমে গিয়ে সঙ্কট বাড়িয়েছে।’’ পুকুর সংস্কার করা পুরসভার কাজ নয়, এটা অন্য দফতর দেখে বলেও জানিয়েছেন বিদায়ী পুরপ্রধান।

বস্তুত, জলের জন্য শহরের গন্ধেশ্বরী ও দ্বারকেশ্বর নদই বাঁকুড়া পুরবাসীর ভরসা। কিন্তু বছরের অধিকাংশ সময়েই দু’টি নদী শুকনো থাকে। পুরসভার আধিকারিকেরাও জানিয়েছেন, গত বছর জেলায় বৃষ্টিপাত সেভাবে হয়নি। তাই মাটির তলার জলস্তর নীচে নেমে গিয়েছে। নদনদী শুকিয়ে কাঠ। এই পরিস্থিতিতে কংসাবতী সেচ প্রকল্প কবে জল ছাড়ে, তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন পুর-আধিকারিকেরা। তাঁদের এক জনের কথায়, “গন্ধেশ্বরী ও দ্বারকেশ্বরের জলস্তর ২৪ থেকে ২৮ ফুট নীচে নেমে গিয়েছে। যন্ত্রের মাধ্যমেও জল টেনে আনা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে কংসাবতী জল না ছাড়া পর্যন্ত জলকষ্ট মিটবে না।’’ তিনি জানান, বিভিন্ন ওয়ার্ডে জলগাড়ি পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একটা চেষ্টা চলছে। তবে মানুষের চাহিদা মিটিয়ে দেওয়ার মতো জলের জোগান নেই।

বাঁকুড়া জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পরেশ রায় বলেন, “দ্বারকেশ্বরের গর্ভে কুয়ো কেটে কোনও রকমে আমরা বাঁকুড়া মেডিক্যালে জল পাঠাচ্ছি। গোটা জেলা জুড়েই জলের সমস্যা হচ্ছে। তবে, কংসাবতী জল ছাড়লেই নদী গুলি জলমগ্ন হবে ও জলসংকট মিটে যাবে।’’ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আগামী সোমবার পানীয় জলের সমস্যা নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন জেলাশাসক বিজয় ভারতী। ওই দিন কংসাবতী প্রকল্পের আধিকারিকেরাও থাকবেন বলে সূত্রের খবর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement