জলে মিশে ‘বিষ’, ভরসা কেবল আশ্বাস

ভূর্গভস্থ জলে মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড মিলেছে সবিতাদেবী যে এলাকায় থাকেন সেখানে। বিপত্তির শুরু তাতেই।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

নসীপুর শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৯ ০২:২০
Share:

পানীয় জলে ফ্লোরাইড। তার থাবা বসেছে শরীরে। নসীপুরে। নিজস্ব চিত্র

অশক্ত শরীরে কোনও ভাবে লাঠির ভরসায় এগিয়ে নিয়ে চলেন তিনি। সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। বছর তিরিশ আগে যখন শরীরে রোগ বাসা বাঁধে তখন থেকে আজ পর্যন্ত কোমর জুড়ে শুধু ব্যথাই ব্যথা। ঘাড় সোজা রাখতে পারেন না। ডান হাত, ডান পা অসাড়। মাথা ঘোরে মাঝেমধ্যেই। রাস্তায় বেরোলে টাল খেয়ে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ঘরেই কার্যত বন্দিদশা নলহাটি থানার নসীপুর গ্রামের সবিতা লেটের।

Advertisement

ভূর্গভস্থ জলে মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড মিলেছে সবিতাদেবী যে এলাকায় থাকেন সেখানে। বিপত্তির শুরু তাতেই। বছর তিরিশ আগে সবিতা লেটের শরীরে বাসা বেঁধেছিল ফ্লুরোসিস। তাতেই অকাল-জরা ঘিরে ধরেছে তাঁকে। তিনি একা নন। গ্রামটিতে অনেকেই এই রোগের শিকার। একই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন সবিতাদেবীর ভাই বাবলু লেট। গ্রামবাসীরা ন-বছর আগে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন তাঁকে। একই ভাবে দেখেছেন কী ভাবে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়েছেন শিক্ষক বিশ্বনাথ দাস।

নসীপুর গ্রাম। অখ্যাত হলেও এখন এই রোগের জন্য জানেন অনেকে। সবিতাদেবীর পাড়ারই বাসিন্দা বিশ্বনাথবাবু। তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণাদেবী বলেন, ‘‘আমার স্বামী ৩০ বছর ধরে এই রোগে ভুগছেন। সাত বছর আগে মারা গিয়েছেন। কোমরের ব্যথায় পাঁচ বছর বিছানা থেকে উঠতেই পারেননি। স্কুল যেতে পারতেন না।’’

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অন্নপূর্ণাদেবীও কোমর ও হাঁটুর ব্যথায় আক্রান্ত। সবিতাদেবী এবং অন্নপূর্ণাদেবী দুজনেই জানালেন গ্রামে ৫০-এর বেশি বয়স্কদের কেউ কেউ না ভূর্গভস্থ জলের মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইডের জেরে এই রোগে আক্রান্ত। তবুও সবিতাদেবীর ঘরে দেখা গেল এখনও ভূর্গভস্থ জলেই সব কাজ করা হয়। সবিতাদেবী জানালেন মাসের মধ্যে দু-তিনবার লোডশেডিং-এর জেরে পাইপ লাইনের জল সরবরাহ বন্ধ থাকে। তখন অনেকে বাধ্য হয়ে বাড়ির নলকূপের জল পানীয় জল হিসাবেই ব্যবহার করেন। গ্রামবাসী কার্তিক রবিদাস, কলেজ লেটরা জানান পাইপ লাইনের জলে মাঝে মাঝে নোংরা আসে। তখন ট্যাপ কলে কাপড় বেঁধে জল নিতে হয়।

নলহাটি থানার এই গ্রামেই রাজ্যের মধ্যে প্রথম ভূগর্ভস্থ পানীয় জলে ফ্রোরাইড পাওয়া যায়। ১৯৯৬ সালে নসীপুর-সহ লাগোয়া ভবানন্দপুর, ভেড়াপাড়া এই সমস্ত এলাকায় ভূর্গভস্থ জলে ফ্লোরাইডের মাত্রা ছিল কোথাও ১৪ মিলিগ্রাম, কোথাও বা ১৫ মিলিগ্রাম কোথাও বা ১৬ মিলিগ্রাম। তৎকালীন বাম আমলে ফ্লোরাইড দূষিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য তিরপিতা নদী থেকে পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা হলেও প্রায় দিনই লোডশেডিং-এর জন্য জল সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যহত হতো। নলহাটি-১ পঞ্চায়েত সমিতি নলহাটি থেকে জলের গাড়ি পাঠিয়ে জলের ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করত। অনেক ক্ষেত্রে জেনারেটর চালিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে জল সরবরাহ করা হতো। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে নতুন করে রিজার্ভার তৈরি হয়। নতুন করে জল সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন পাইপ লাইনও বসানো হয়। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিযোগ, নতুন পাইপ লাইন মাটির নীচে ৫ ইঞ্চি গভীরে না করে ২ ইঞ্চি গভীরে বসানো হয়েছে। এর ফলে পাইপ লাইনে অনেক সময় ফাটল দেখা যায় এবং জল সরবরাহ বাধা প্রাপ্ত হয়।

এছাড়াও নতুন পাইপ লাইন এলাকার সমস্ত জায়গায় এখনও পর্যন্ত পৌঁছয়নি। ভবানন্দপুর গ্রামের উত্তর পাড়ার বাসিন্দা দীপালি লেট, বিষ্ণু কোনাইরা জানান, পাইপ লাইন এলাকায় না পৌঁছনোর জন্য ২০০ মিটার দূরত্বে অন্য পাড়া থেকে জল নিয়ে আসতে হয়। নসীপুর, ভবানন্দপুর এলাকার বাসিন্দারা জানান বাড়িতে বাড়িতে জল সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা দরকার।

বাড়ি বাড়ি জল সংযোগ দেওয়ার ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের রামপুরহাট বিভাগীয় বাস্তুকার সরোজ চৌধুরী বলেন, ‘‘ফ্লোরাইড দূষিত এলাকায় বাড়ি বাড়ি জল সংযোগ দেওয়ার আওতাভূক্ত নয় প্রকল্পটি।’’ নলহাটি-১ ব্লকের বিডিও জগদীশচন্দ্র বাড়ুই বলেন, ‘‘বাড়ি বাড়ি জল সংযোগ দেওয়ার প্রকল্প বর্তমানে বন্ধ আছে। পঞ্চায়েত নিজেদের দায়িত্বে বাড়ি বাড়ি জল সংযোগ দিতে পারে। সেক্ষেত্রে খরচের দায়ভার এবং আয় ব্যয়ের হিসাব পঞ্চায়েতকে রাখতে হবে। নতুন কোনও প্রকল্পের মাধ্যমে ফ্লোরাইড দূষিত এলাকায় যাতে সব সময়ের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করা যায় তার ভাবনা চিন্তা করা হবে।’’ আক্রান্তদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে যাতে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট বিএমওএইচ-এর সঙ্গে আলোচনা করবেন বলেও বিডিও আশ্বাস দেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement